পকৌড়া আর স্টার্ট-আপ


ইনোভেশন শব্দটার বাংলা কী হবে? উদ্ভাবনা আর মৌলিকতা মিশিয়ে একটা অর্থ পাওয়া যায়, কিন্তু একটা শব্দ? পাওয়া মুশকিল। 'স্টার্ট-আপ'-এর সংজ্ঞা দিতে গেলে 'ইনোভেশন'-এর একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। 'স্টার্ট-আপ' বলতে ঠিক কী বোঝায়, তার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কিন্তু তিনটি বিষয়ে মোটামুটি মতৈক্য আছে: এক, 'স্টার্ট-আপ' ব্যবসায়িক সংস্থার বয়স দশ বছরের আশেপাশে হতে হবে, তার চেয়ে খুব বেশি হলে চলবে না; দুই, 'নেট ওয়ার্থ' অর্থাৎ সংস্থার বাজার-নির্ধারিত মূল্যায়ন খুব দ্রুত, প্রায় চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে হবে; তিন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সংস্থাটির উৎপাদিত দ্রব্য বা ব্যবসায়িক মডেলের মধ্যে থাকতে হবে প্রযুক্তিগত বা ব্যবসায়িক 'ইনোভেশন'— যে 'ইনোভেশন' ওই পণ্য বা পরিষেবার বাজারকে আমূল বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ইংরেজিতে যাকে বলে 'ডিসরাপ্টিভ ইনোভেশন'।

২০১৫-র স্বাধীনতা দিবসে 'স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া' প্রকল্পের ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ''ভারতে এমন কোনও জেলা, ব্লক থাকবে না যেখানে 'স্টার্ট-আপ' শুরু হবে না।'' তিনি সম্ভবত যে কোনও নতুন ব্যবসা বা দোকানকেই 'স্টার্ট-আপ' ভেবে বসেছিলেন। কিন্তু, যে কোনও দোকান বা ছোট কারখানা 'স্টার্ট-আপ' নয়, হতে পারে না। গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল, অ্যামাজ়ন, অথবা ভারতের ক্ষেত্রে ফ্লিপকার্ট, ওলা বা পেটিএম হতে পারে 'স্টার্ট-আপ'-এর উদাহরণ, যে কোনও পানের দোকান বা ছোট প্লাস্টিকের কারখানা নয়।

অনুমান করা যায়, স্বপ্ন ছিল ভারতের দিকে দিকে আমেরিকার স্যানফ্র্যান্সিসকো বে এরিয়ার সিলিকন ভ্যালির মতো 'স্টার্ট-আপ হাব' বানিয়ে ফেলা। কিন্তু, সিলিকন ভ্যালি এক দিনে তৈরি হয়নি। রেডিয়ো, ইলেকট্রনিক এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির এক লম্বা ইতিহাস আছে সিলিকন ভ্যালির পিছনে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানের অবদান আছে। লগ্নিকারীদেরও— বিশেষ করে যাঁদের 'ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট' বলা হয়— মস্ত ভূমিকা আছে। সিলিকন ভ্যালির সাফল্যের পিছনে মার্কিন সরকারের প্রত্যক্ষ নীতিগত অবদান ন্যূনতম বললেই চলে।

সুতরাং 'স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া' শুরু করলেই দেশে রাশি রাশি 'স্টার্ট-আপ' তৈরি হয়ে যাবে আর তাতে তৈরি হবে কোটি কোটি চাকরি, এই খোয়াব যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। তথ্য আর পরিসংখ্যানও তাই বলছে। নতুন তৈরি হওয়া স্টার্ট-আপগুলো স্বাভাবিক ভাবেই কম কর্মী নিয়োগ করে কাজ চালাতে চাইবে, কারণ গোড়ায় তাদের লক্ষ্য খরচ যতটা সম্ভব কম রাখা। দশ জনেরও কম কর্মী নিয়ে ব্যবসা চলছে, এ রকম স্টার্ট-আপের সংখ্যা কত? ২০১৭ সালে তৈরি হওয়া স্টার্ট-আপগুলোর ৮৬ শতাংশতেই কর্মীর সংখ্যা দশের কম। ২০১৪ এবং ২০১২ সালে তৈরি হওয়া প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্ট-আপ সংস্থার যথাক্রমে ৫৩% এবং ১৭% এখনও দশ জনের কম কর্মী নিয়ে ব্যবসা চালায়। ৫০ জনের কম কর্মী নিয়ে ব্যবসা চালায় যথাক্রমে ৯৯, ৯০ ও ৭১ শতাংশ 'স্টার্ট-আপ'। নতুন প্রযুক্তি-নির্ভর স্টার্ট-আপের সংখ্যা ২০১৭ সালে ২৯% কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজারে। প্রতি জেলা, প্রতি ব্লকে বা প্রতি গ্রামে তো দূরস্থান, দেশের প্রতি তিনটি স্টার্ট-আপের মধ্যে দু'টিই তৈরি হয়েছে বেঙ্গালুরু, দিল্লি আর মুম্বইয়ে। স্টার্ট-আপের হাত ধরে কর্মসংস্থান? সে অন্য সাধনার ফল।

স্টার্ট-আপে লগ্নির ক্ষেত্রেও ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান তাৎপর্যপূর্ণ। স্টার্ট-আপে যে কোনও ধরনের লগ্নির পরিমাণ কমেছে প্রায় ১৪%। আর, লগ্নির সংখ্যা কমেছে ১৭%। তার চেয়েও বড় কথা, বৃহত্তম পঞ্চাশটি লগ্নির পরিমাণই স্টার্ট-আপে মোট লগ্নির প্রায় ৪৫%। অর্থাৎ, কিছু বড় স্টার্ট-আপ প্রচুর লগ্নি টানতে সক্ষম হলেও, বেশির ভাগ বিশেষত ছোট স্টার্ট-আপগুলি, খুব বেশি লগ্নি জোগাড় করে উঠতে পারেনি। যে সমস্ত 'স্টার্ট-আপ' বাজার মূল্যায়নে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাপিয়ে যায়, দুনিয়া জুড়ে তাদের 'ইউনিকর্ন' বলা হয়। ভারতে এমন ইউনিকর্নের সংখ্যা ১০। এই ১০টি ইউনিকর্নই বাজার থেকে বেশির ভাগ লগ্নি পুঁজি টেনে নিয়েছে। অবশ্য ইউনিকর্নদের বাজারভিত্তিক মূল্যায়নের মানে এই নয় যে এরা প্রচুর লাভ করছে। ভারতীয় স্টার্ট-আপের মধ্যে ডেটা অ্যানালিটিক্স সংস্থা 'মিউ সিগমা' এবং বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম 'ইনমোবি' ছাড়া কেউ লাভের মুখ দেখেনি এখনও পর্যন্ত।

নরেন্দ্র মোদীর 'স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া' প্রকল্প এই নতুন ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির কতখানি কাজে এসেছে? সরকারের নিজস্ব 'স্টেটাস রিপোর্ট' অনুযায়ী মোট ৪৫৩৬টি সংস্থা 'স্টার্ট-আপ' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মজার কথা, এই তালিকার বেশ কিছু স্টার্ট-আপকে আলাদা ভাবে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছে যে এই স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না এবং এই স্বীকৃতি পাওয়াটা লাভজনক কি না, সেই বিষয়েও তারা নিশ্চিত নয়। কিছু স্টার্ট-আপ হয়তো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচারে কিছু লাভ পেয়েছে, কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা এক সমীক্ষায় ৮০ শতাংশ স্টার্ট-আপ জানিয়েছে যে সরকারি 'স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া'র ফলে তাদের বিশেষ লাভ হয়নি।

৭৪টি স্টার্ট-আপকে কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সংখ্যাটা অকিঞ্চিৎকর। তা ছাড়া, সরকারের কর ছাড় নীতি নিয়েও বেশির ভাগ স্টার্ট-আপই অখুশি। গোড়ায় স্থির হয়েছিল, প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে যে কোনও তিন বছর কর ছাড় দেওয়া হবে। স্টার্ট-আপে লাভের মুখ দেখতে সাধারণত আরও বেশি সময় লাগে। সেই আপত্তির ফলে নতুন সিদ্ধান্ত হয়, পাঁচ নয়, প্রথম সাত বছরের মধ্যে যে কোনও তিন বছর এই ছা়ড় পাওয়া যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের মতে, এটাও যথেষ্ট নয়। অন্তত দশ বছরের কর ছাড়ের ব্যবস্থা হলে শিল্পে উৎসাহ বাড়ত।

'স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া'-র অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী একটি দশ হাজার কোটি টাকার 'ফান্ড অব ফান্ডস' তৈরি করা হয়েছিল পরবর্তী চার বছরের জন্য। সরকারের তরফ থেকে স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ় ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (সিডবি) এই তহবিল থেকে টাকা দেবে বলা হয়েছিল। তবে, সরাসরি স্টার্ট-আপগুলোর হাতে নয়, টাকা দেওয়া হবে কিছু বৈকল্পিক লগ্নিকারী তহবিলকে। তারা সব দিক দেখেশুনে যোগ্য স্টার্ট-আপগুলোকে সেই পুঁজি দেবে। দুই বছর অর্থাৎ তহবিলের আয়ুর অর্ধেক পেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত দশ হাজার কোটির মাত্র ১০ শতাংশ পাওয়া গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। সিডবি ৬০৫.৭ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিছু স্টার্ট-আপকে। ৯০.৬২ কোটি টাকা গিয়েছে বৈকল্পিক লগ্নিকারী তহবিলগুলির কাছে। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হবে, তবুও 'ফান্ড অব ফান্ডস'-এর লক্ষ্যের ধারেকাছেও পৌঁছনো যাবে না। তহবিলের প্রচার অনেক হলেও আসল লগ্নি প্রায় হয়নি বললেই চলে।

কিছু দিন আগে বিজেপি সভাপতি বলেছিলেন যে সবাইকে চাকরি দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তার জন্যই স্বনির্ভর প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। 'স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া' এই স্বনির্ভরতায় উৎসাহ দেওয়ার নীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল বার বার। বাস্তব বলছে, নরেন্দ্র মোদীর আর পাঁচটা প্রতিশ্রুতির মতো এটাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।