জুতোর মালা পরিয়ে ঘোরানো হল দলীয় পঞ্চায়েত সদস্যের স্ত্রীকে, অভিযুক্ত তৃণমূলই


দলীয় কার্যালয়ের সামনেই কান ধরে ওঠবোস করানো হল কবিতাদেবীকে।

জুতোর মালা পরিয়ে গ্রামে ঘোরানো হল এক মহিলাকে। তিনি তৃণমূলেরই কর্মী। দলের অফিসের সামনে কান ধরে ওঠবোস করানো হল। অভিযুক্ত তৃণমূলেরই কয়েকজন কর্মী। ঘটনা মেদিনীপুর সদর ব্লকের কনকাবতীর বাগডুবির। ভয়ঙ্কর এই ঘটনার ছবি সামনে আসতে শোরগোল পড়েছে শাসক দলের অন্দরেও। সামনে এসেছে মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়টি। তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি অজিত মাইতি বলেন, "মেদিনীপুরের এই ঘটনার কথা শুনেছি। বিস্তারিত খোঁজখবর নিচ্ছি। এ সব বরদাস্ত করা হবে না। দল কড়া ব্যবস্থা নেবে।"

হেনস্তার শিকার হওয়া ওই মহিলার নাম কবিতা পাত্র। কবিতাদেবী বলেন, "দলেরই কয়েকজনের হাতে চরম হেনস্তা হতে হয়েছে। এটাই খারাপ লাগছে। আমি তৃণমূলেরই কর্মী। কখনও ভাবিনি আমার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে।" কবিতাদেবীর স্বামী গোপাল পাত্র গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই এলাকা থেকে তৃণমূলের টিকিটে জিতেছিলেন। এ বার আসনটি মহিলা সংরক্ষিত হয়েছে। গোপালবাবু বলেন, "আমি এখনও পঞ্চায়েতের সদস্য। তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। এরপর আর তৃণমূল করব কি না ভাবছি।" কেন কবিতাদেবীর উপর এমন নির্যাতন? স্থানীয় সূত্রে খবর, ভোটের দিনে বুথ জ্যামের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। এক তৃণমূলকর্মীকে জুতোও দেখিয়েছিলেন। কবিতাদেবীর কথায়, "অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু তার শাস্তি যে এমন হতে পারে ভাবিনি।" মহিলা সংরক্ষিত এই আসনে এ বার দু'জন প্রার্থী ছিলেন। তৃণমূলের কৃষ্ণা সিংহ এবং নির্দল শিখা পড়্যা। তৃণমূলের এক সূত্রের দাবি, কবিতাদেবী নির্দল প্রার্থীর সমর্থক। ওই মহিলা অবশ্য তা মানেননি।

স্থানীয় সূত্রে খবর, শুক্রবার বিকেলে প্রথমে তৃণমূলের স্থানীয় অফিসে ডাকা হয় গোপালবাবুকে। পরে তাঁর স্ত্রী কবিতাদেবীকেও ডাকা হয়। দলীয় অফিসের মধ্যেই 'বিচারসভা' বসে। কেন তিনি বুথ জ্যামেরা প্রতিবাদ করেছিলেন, দলের এক কর্মীকে জুতো দেখিয়েছিলেন, তার কৈফিয়ত চাওয়া হয়। তৃণমূলের অফিসে তখন ছিলেন আশিস পাত্র, বাদল পাত্র, লক্ষ্মী কুইল্যা, সঞ্জীত কুইল্যারা। সকলেই তৃণমূলের নেতা- কর্মী। আশিসবাবু দলের বুথ সভাপতি। ভোটের দিনের ওই ঘটনার জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন কবিতাদেবী। তিনি জানান, উত্তেজনারবশেই তিনি ওই কাজ করেছিলেন। তাঁর কথায়, "এক জায়গায় জটলা ছিল। মনে হয়েছিল, আমার স্বামীকে মারধর করা হচ্ছে। তখনই মেজাজ হারাই।" স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য জানিয়ে দেন, শুধু ক্ষমা চাইলে হবে না। জুতোর মালা পরে গ্রামে ঘুরতে হবে। সকলের কাছে কান ধরে ওঠবোসও করতে হবে। স্থানীয় এক তৃণমূলকর্মী জানাচ্ছেন, "ওই মহিলাকে দু'টোর যে কোনও একটা শর্ত মানতে বলা হয়েছিল। জুতোর মালা পরে ঘোরা এবং কান ধরে ওঠবোস করাটা এরমধ্যে একটা। আরেকটা শর্ত মানতে গেলে ওই মহিলার ইজ্জত থাকত না। যে কোনও মহিলার পক্ষেই ওই আরেকটা শর্ত মানা কঠিন হত।"

অভিযুক্ত নেতারা অবশ্য দায় ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত। তৃণমূলের বুথ সভাপতি আশিস পাত্র বলেন, "গ্রামে এ রকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। অন্তত আমার জানা নেই!" ছবি রয়েছে যে? এরপর আশিসবাবুর দাবি, "আমি ওই দিন দলের অফিসেই যাইনি!" কবিতাদেবী কি নির্দলের সমর্থক? স্থানীয় তৃণমূল নেতা লক্ষ্মী কুইল্যা বলেন, "ও নির্দলের হয়ে কাজ করেছে বলেই আমাদের কাছে খবর ছিল।" কিন্তু কবিতাদেবীর স্বামী তো গতবার দলের প্রতীকেই জিতেছেন। এখনও পঞ্চায়েত সদস্য রয়েছেন। নিজেও দাবি করেছেন উনি তৃণমূলের কর্মী। তবে? এ বার লক্ষ্মীবাবুর জবাব, "ও যে তৃণমূল, সিপিএম না নির্দল আমরা এখনও বুঝতে পারিনি।" মেদিনীপুর সদর ব্লকের কনকাবতী গ্রাম পঞ্চায়েতেও এ বার বিজেপি আঁচড় কেটেছে। কনকাবতীতে ১৬টি আসন। এরমধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ১১টি, বিজেপি ৪টি, নির্দল ১টি। গতবার তৃণমূল পেয়েছিল ১৪টি, সিপিএম ২টি। বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছে, মনোনয়নপর্বে বিরোধী মহিলা প্রার্থীরাও হেনস্তার হাত থেকে রেহাই পাননি। এ বার শাসক দলের কর্মীও হেনস্তার মুখে পড়লেন। অভিযুক্ত সেই শাসক দলের কয়েকজন কর্মীই।

বিজেপির জেলা সম্পাদক অরূপ দাসের কথায়, "এ তো মধ্যযুগীয় বর্বরতা। তালিবানি শাসনের মতো।" তাঁর কথায়, "মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর শাসনে যে মহিলারা নিরাপদ নন, এ ঘটনা তারই আরেকটা প্রমাণ। মহিলাকে এ ভাবে হেনস্তা করা অকথ্য নির্যাতনেরই সমান।" অরূপবাবুর মন্তব্য, "আসলে এ সবই উন্নয়ন!"