প্রকাশ্য আলিঙ্গন কি অপরাধ? আইন কী বলছে


মুখে নীতি পুলিশের দাদাগিরির নিন্দা করলেও, কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে সংযত আচরণ করার উপদেশ দিয়ে ফের বিতর্কে মেট্রো কর্তৃপক্ষ।

বুধবার মেট্রো ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনের শেষে, মেট্রো রেলের জেনারেল ম্যানেজার অজয় বিজয়বর্গীয় মন্তব্য করেন, "যাত্রীদের উদ্দেশে অনুরোধ, তাঁরা এমন কিছু করবেন না যাতে সহযাত্রীদের অসুবিধা হয়। এবং, যাত্রীদের কলকাতা মেট্রোর সম্মানের কথা মাথায় রাখতে হবে।"

এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। তিনি তাঁর হাতে রাখা ছাপানো বিবৃতি থেকে পড়তে থাকেন— "যাত্রীদের কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা মাথায় রাখতে অনুরোধ করছি এবং তাঁরা যেন সংযত আচরণ করেন।"

কিন্তু কার উদ্দেশে এই উপদেশ? সেই যুগল যাঁরা মেট্রোর কামরায় আলিঙ্গন করে নিগৃহীত হলেন, না যাঁরা নিজেদের অসহনশীলতার পরিচয় দিয়ে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওই তরুণ-তরুণীর উপর?
সেই প্রশ্নের কোনও সোজাসুজি উত্তর দেননি বিজয়বর্গীয়। "আমরা সব যাত্রীকেই বলছি"— বলেন মেট্রোর জেনারেল ম্যানেজার। তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক আরও বেশি উস্তে উঠেছে কারণ, মঙ্গলবার সন্ধে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট ভাইরাল হতে শুরু করেছিল। সেই পোস্টটি আপাতভাবে মেট্রো রেলের নিজস্ব ফেসবুক পেজে করা একটি মন্তব্য— "যাত্রীরা কি এমন অন্যায় করেছেন? দীর্ঘ দিন ধরে যুব সমাজের একটি অংশ যে অভব্যতা-অশালীন আচরণ করছেন, তারই ফলাফল এই ঘটনা। মেট্রোতে যাতায়াত করা যুবক-যুবতীরা আদৌ কোনও সহবত জানেন না। তাদের এই ঔদ্ধত্য এবং আচরণ না শোধরালে, খালি মেট্রো নয়, সব জায়গাতেই এই ঘটনা ঘটবে।"

সোশ্যাল মিডিয়াতে দাবি করা হয়েছে, এই মন্তব্য মেট্রোর ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়েছিল, কিন্তু ব্যাপক সমালোচনার আশঙ্কায় তড়িঘড়ি সেই পোস্ট মুছে ফেলা হয়। যদিও ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, মেট্রোর মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক, এই পোস্টটিকে জাল বলে দাবি করেন। "আমরা ১ মে একটি মাত্র পোস্ট করেছিলাম, যেখানে নীতি পুলিশগিরির কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে"— বলেন ইন্দ্রাণী। কিন্তু তার পরেও খোদ জেনারেল ম্যানেজারের 'উপদেশ'-এর মধ্যে সেই সহবত শেখানোর সুর প্রশ্ন তুলেছে নতুন করে।

প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া বা আলিঙ্গন কি আদৌ আইনত অপরাধ, তা নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে। কারণ বিভিন্ন জায়গায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারাকে হাতিয়ার করে পুলিশ প্রকাশ্যে আলিঙ্গন এবং চুমু খাওয়াকে আইন বিরুদ্ধ দাবি করলেও, সেই আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ শীর্ষ আদালত।

২০০৭ সালে হলিউড অভিনেতা রিচার্ড গ্যের ও বলিউড তারকা শিল্পা শেট্টির প্রকাশ্য চুম্বন বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সেই সময়, হলিউড অভিনেতার বিরুদ্ধে জয়পুর আদালতের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানাকে খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। "স্ব-ইচ্ছায় দু'জন পরস্পরকে আলিঙ্গন বা চুম্বন করা অপরাধ নয়"— মন্তব্য করেছিল শীর্ষ আদালত। ২৯৪ ধারা অনুযায়ী, প্রকাশ্য স্থানে অশ্লীলতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একাধিক এই ধরনের মামলায় শীর্ষ আদালত বার বার বলেছে যে, ভারতীয় দণ্ডবিধি অশ্লীলতার কোনও সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করেনি এবং এই সংজ্ঞা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক সমাজের উপর।

প্রায় অর্ধশতক আগে, ১৯৬৯ সালে, বিখ্যাত চন্দ্রকান্ত কল্যাণদাস মামলায়, অশ্লীলতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল, "ভারতীয় সমাজে সমসাময়িকতার মাপকাঠি খুব দ্রুত বদলাচ্ছে।" ঠিক একই ভাবে ২০১০ সালে খুশবু বনাম কানাইলাল মামলাতেও শীর্ষ আদালত খুব স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছে, "অশ্লীলতার সংজ্ঞা দেওয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাই যে, সমাজে শিষ্টাচার ও নৈতিকতার ধারণার সবসময়ে বদল হচ্ছে।" ২০০৯ সালেও দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলিধর একটি প্রকাশ্য চুম্বনের মামলায় বলেন, "এটা কখনও গ্রহণযোগ্য নয় যে, এক দম্পতির প্রকাশ্যে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ আইনত অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ এই বক্তব্যই আরও সহজ ভাষায় বলেন- "একটা সময় মেয়েদের ওড়না ব্যবহার না করাটা অশ্লীল হিসাবে ধরা হত। আজ সেটাই খুব স্বাভাবিক।" তিনি মেট্রোর ঘটনার দিনই নীতিপুলিশির বিরুদ্ধে জোরালো ভাবে মুখ খুলেছিলেন। এ দিন সেই প্রসঙ্গ টেনে ফের বলেন, "অনেকেই বাসে-ট্রেনে বা অন্য জায়গায় মহিলাদের যে ভাবে দেখেন, তাঁদেরই তো শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেফতার করা উচিত। মুশকিল হচ্ছে এই সব লোকদেরই একাংশ সমাজে নীতিপুলিশের ভূমিকায় নেমে পড়ে।" অরুণাভ যোগ করেন, কোনও পরিস্থিতিতেই কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। তাই যারা এই কাজ করল তাদের আগে গ্রেফতার করতে হবে।