ট্রেনে দশ টাকার ঠান্ডা জলে তেষ্টা মেটাচ্ছেন? আদতে বিষ পান করছেন না তো!


বারাসত: জলই জীবন। আবার কোথাও কোথাও তা মরণের আর এক নাম। তাও বোতলবন্দি। "ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল।" প্যাচপেচে গরমে যা দেখলেই প্রাণ চায় গলায় ঢালতে।

যেমন শহরতলির লোকাল ট্রেনে। 'গরমে দশ টাকায় গলা ভেজান। বরফ-ঠান্ডা জল।'– হকারদের এই স্লোগানে প্রতিটি কামরা মুখরিত। গুমোট গরমে দশ টাকায় এক বোতল স্বস্তি যেন হাতের মুঠোয়। কিন্তু গাঁটের কড়ি খসিয়ে যাঁরা সেই স্বস্তি গলাধঃকরণ করছেন, তাঁরা কি জানেন, জলের বদলে আদতে বিষ পান করছেন?

না জানলে এবার জেনে রাখুন, এটাই সত্যি। কারণ উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরে অভিযান চালিয়ে, লোকাল ট্রেনের দশ টাকার বরফজলের রহস্য ফাঁস করেছে জেলা এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ (ডিইবি)। শহরতলির লোকাল ট্রেনে একটি বেসরকারি সংস্থার জল কারখানাটিতে মঙ্গলবার হানা দিয়ে অফিসাররা জানতে পারেন, ঠান্ডা জলের নামে আদতে কী বিক্রি হচ্ছে। ডিইবি সূত্রে খবর, জল বোতলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে এবং 'প্যাকেজড ড্রিঙ্কিং ওয়াটারের' মতো স্বাদ আনতে সোডিয়াম মেটাবাইসালফাইট ও রিট্রিট ১০১ নামে বিপজ্জনক রাসায়নিক মিশিয়ে বোতলবন্দি করা হচ্ছিল সেখানে। পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসব চৌধুরি জানিয়েছেন, "সোডিয়াম মেটাবাইসালফাইট খুব সামান্য পরিমাণে নিলেও ক্ষতিকর হতে পারে। এই রাসায়নিক মানবদেহে এক সঙ্গে দশ গ্রাম গেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।" ডিইবি সূত্রে খবর, কোনও নির্দিষ্ট পরিমাপ ছাড়াই আন্দাজে এই রাসায়নিকগুলি মিশিয়ে জল বোতলবন্দি করত এই সংস্থা। আর এই জলের মাধ্যমে সেই মারাত্মক রাসায়নিকই হাজারও মানুষের দেহে প্রবেশ করছে।


ডিইবি কর্তাদের দাবি, বোতলবন্দি পানীয় জল বিক্রি করার জন্য সরকারের যে ন্যূনতম ছাড়পত্রগুলি প্রয়োজন, তার একটিও ছিল না ওই সংস্থার। উপরন্তু বোতলের গায়ে আইএসআই ছাপ দিয়ে দেদার এই বিষ জলের ব্যবসা চালাচ্ছিল তারা। প্রশাসনের হাত থেকে বাঁচতে বোতলের গায়ে কারখানার ভুল ঠিকানাও দিয়েছিল তারা। রেলের কম্পার্টমেন্টে দশ টাকার এই ভেজাল জলের উপর অনেক দিন ধরেই নজরদারি চালাচ্ছিল ডিইবি। কিন্তু বোতলে ভুল ঠিকানা থাকার কারণে এই কারখানার হদিশ পাচ্ছিলেন না তদন্তকারীরা। অবশেষে গোপন সূত্রে কারখানার সন্ধান মেলে। মঙ্গলবার ডিইবির আধিকারিক তপন বসাকের নেতৃত্বে একটি দল দত্তপুকুর থানার জয়পুল নবজীবনপল্লির কারখানায় হানা দিয়ে সেই রাসায়নিক-সহ কয়েক হাজার ভেজাল জলের বোতল বাজেয়াপ্ত করে। ডিইবি সূত্রে জানা যায়, নিজের বাড়িতে দোতলা কারখানা বানিয়ে এই বিষাক্ত জলের কারবার চালাচ্ছিল প্রবীরকুমার রক্ষিত নামে ওই সংস্থার মালিক। বেআইনি কারখানাটি সিল করে দেওয়া হয়েছে। সব তথ্যপ্রমাণ হাতে পাওয়ার পর প্রবীর-সহ সংস্থার ম্যানেজার প্রণব চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে মালিক গ্রেপ্তার হলেও রেলের হকার ও বাজারে এখনও ওই সংস্থার বহু বোতল ছড়িয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিইবি কর্তারা।

ধৃতদের জেরা করে ডিইবি জানতে পেরেছে, ৫০০ এমএল, এক লিটার, দুই লিটার ও কুড়ি লিটার- এই চারটি মাপের জলের বোতল বানায় এই সংস্থা। সব থেকে বেশি বিক্রি হয় ৫০০ এমএল-এর বোতল। কারণ সেগুলি যেত রেলের হকারদের কাছে। পাঁচ টাকা দশ পয়সা দামে রেলের হকারদের কাছে বিক্রি করত তারা। সেগুলিই কম্পার্টমেন্টে দশ টাকার ঠান্ডা জল হিসাবে বিক্রি হয়। এক ও দুই লিটারের বোতলগুলি যেত বিভিন্ন দোকানে। কুড়ি লিটারের জারগুলি বাড়ি ও দপ্তরে সরবরাহ করা হত। নিজের তিনটি মালবাহী গাড়িতে করে প্রতিদিন কয়েক হাজার বোতল কলকাতা-সহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হত এই কারখানা থেকেই। একটি গাড়ি মঙ্গলবার রাতে বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। বাকি দু'টির খোঁজ চলছে। পাশাপাশি এই বেআইনি সংস্থার সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত বলে জানতে পেরেছে ডিইবি। তাদের খোঁজেও তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। ধৃতদের জেরা করে এই চক্রে আরও কারা রয়েছে তারও সন্ধান করছে পুলিশ।