আট বছর ধরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি থেকে পাচার হত অস্ত্র! জেরায় জানাল ধৃতেরা


উদ্ধার হওয়া অস্ত্রশস্ত্র!

সরষের মধ্যেই ভূত! অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ভিতর থেকেই পাচার হয়ে যাচ্ছে সেনা ও পুলিশের জন্য তৈরি করা অত্যাধুনিক অস্ত্র! আর সেই আগ্নেয়াস্ত্রই বিহার ও ঝাড়খণ্ডের চোরাই অস্ত্রকারবারীদের হাত ঘুরে কখনও মাওবাদী বা কখনও পৌঁছে যাচ্ছে পড়শি দেশেও। কুখ্যাত অপরাধীদের হাতে হাতে ঘুরছে ওই হাতিয়ার। আর গোটা চক্রের শিকড় লুকিয়ে রয়েছে রাইফেল ফ্যাক্টরির মধ্যেই।

কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) রবিবার রাতে বাবুঘাট থেকে এই অস্ত্র পাচারচক্রের চার জনকে গ্রেফতার করে ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে তৈরি আটটি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে সাতটি ০.৩৮ বোরের রিভলবার এবং একটি কার্বাইন। পাওয়া গিয়েছে ১০ রাউণ্ড বুলেট ও কার্বাইনের দু'টি ম্যাগাজিন। ধৃতদের মধ্যে অজয় পণ্ডিত ওরফে গুড্ডু এবং জয়শঙ্কর পাণ্ডে বিহারের কুখ্যাত অস্ত্র কারবারী। ওই দু'জনকে অস্ত্র ডেলিভারি করতে এসেছিল ইছাপুরের বাসিন্দা উমেশ রায় এবং কার্তিক সাউ। কার্তিক এবং উমেশকে জেরা করেই হদিশ মেলে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির দুই জুনিয়র ওয়ার্কস ম্যানেজার সুখদা মুর্মু এবং সুশান্ত বসুর। সোমবার ভোরেই গোয়েন্দারা হানা দেন রাইফেল ফ্যাক্টরির ওই দুই কর্মীর বাড়িতে।

কলকাতা পুলিশের ডিসি (এসটিএফ) মুরলিধর শর্মা সোমবার বলেন, "গত আট বছর ধরে রাইফেল ফ্যাক্টরি থেকে অস্ত্র পাচারের সঙ্গে যুক্ত অজয়। জেরায় সে স্বীকার করেছে, গত দু'বছরে কমপক্ষে ১৬টি ইনস্যাস ও ৪টি এসএলআর রাইফেল সে ইছাপুর থেকে কিনেছে। সেই অস্ত্র বিহারের বাহুবলী, মাওবাদী এবং তৃতীয় প্রস্তুতি কমিটির সদস্যদের কাছে বিক্রি করেছে অজয়।"
 
কিন্ত, কী ভাবে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির মতো হাই সিকিউরিটি জোন থেকে এই অস্ত্র পাচার হত?

ধৃতদের জেরা করে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, তৈরি হওয়া অস্ত্রের একটা অংশ বাতিল করা হয় উৎপাদনগত ত্রুটির জন্য। সেই সমস্ত বাতিল অস্ত্র জমা করা হয় নির্দিষ্ট ভাঁড়াড়ে। সেখান থেকেই সুশান্ত বসু বা সুখদা মুর্মুর মতো কর্মীদের সাহায্যে বাইরে চলে আসত অস্ত্র। ধৃত উমেশ এবং কার্তিক রাইফেল ফ্যাক্টরির জঞ্জাল সাফাইয়ের ঠিকাদার। সেই সূত্রে কারখানা চত্বরে এদের নিয়মিত যাতায়াত এবং সব ধরনের কর্মীর সঙ্গে আলাপ। সেই সূত্রেই রাইফেল ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা রক্ষাদের নজর এড়িয়ে তারা বাইরে নিয়ে এসেছিল এই অস্ত্র। এসটিএফ-এর এক অফিসার বলেন, "মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় এক একটি রিভলবার বিহারের কারবারীদের হাতে তুলে দিত কার্তিক এবং উমেশ। এক একটি ইনস্যাস অজয়রা বিহারে প্রায় তিন লাখ টাকায় বিক্রি করলেও এখান থেকে কিনত মাত্র কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকায়।"

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, রাইফেল এরা কখনওই গোটা নিয়ে যেত না। ধরা পড়ার সম্ভাবনা এড়াতে সমস্ত যন্ত্রাংশ আলাদা আলাদা করে বাস বা ট্রেনে করে নিয়ে যেত। ২০১৬ সালে এক দফায় তারা ১১টা রাইফেল নিয়ে গিয়েছিল। সে বার অজয় এবং তার সঙ্গীরা বিহার থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছিল।

অস্ত্রপাচার কাণ্ডে ধৃতেরা। বাঁ দিক থেকে অজয়কুমার পাণ্ডে, উমেশ রায়, জয়শঙ্কর পাণ্ডে এবং কার্তিক সাউ।—নিজস্ব চিত্র।​
অজয়কে জেরা করে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালে সে একই ভাবে অস্ত্র পাচার করতে গিয়ে পটনা এসটিএফের হাতে ধরা পড়েছিল। খালি ইছাপুর নয়, ভারতের অন্যান্য প্রান্তেও বিভিন্ন অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি থেকে এর আগে অস্ত্র বা বুলেট কিনেছে অজয়, জেরায় এমনটাই জানিয়েছে সে। এসটিএফ-এ ওই অফিসার আরও বলেন, "পঞ্জাবের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি থেকে সম্প্রতি বুলেট কিনেছিল অজয়।" তদন্তকারীদের সন্দেহ, নেপালের কোনও গোষ্ঠীর কাছেও অস্ত্র বিক্রি করেছে অজয়ের দলবল। "গত আট বছরে বিপুল পরিমান অস্ত্র পাচার করেছে এই চক্র। খোদ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির মধ্যেই রয়েছে চক্রের মূল মাথারা,"—দাবি এক তদন্তকারীর।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ভিতরে চলা এই দুর্নীতি সামনে আসে যখন সংস্থার ভিজিল্যান্স অফিসার গৌতম মণ্ডল ফ্যাক্টরিতে চলা অনিয়মের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে সিবিআই। পাশাপাশি অস্ত্র পাচার নিয়ে তদন্ত শুরু করে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ। ১৭ অক্টোবর গৌতম মণ্ডলের অভিযোগে মামলা শুরু করে সিবিআই। সেই দিনই ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরির এক জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র শম্ভু ভট্টাচার্যকে হাতেনাতে পাকড়াও করেন গোয়েন্দারা। শম্ভুকে সঙ্গে নিয়ে গোয়েন্দারা হানা দেন নোয়াপাড়ার বাসিন্দা দীপক সাউ-এর বাড়িতে। ধৃতদের কাছ থেকে কুড়িটি এসএলআর রাইফেলের ম্যাগাজিন ছাড়াও ইলস্যাসের ট্রিগার, হ্যামার-সহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ উদ্ধার করা হয়।