ওডিশায় পৃথিবীর প্রাচীনতম খনিজ, সাক্ষাত্কারে আবিষ্কর্তা বাঙালি বিজ্ঞানী



পূর্ব ভারতে আগ্নেয়শিলার মধ্যে পৃথিবীর প্রাচীনতম খনিজ 'জ়ারকন'-এর খোঁজ পেলেন দুই বাঙালি ভূবিজ্ঞানী, মালয়েশিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের শিক্ষক, রজত মজুমদার ও তাঁরই ছাত্রী সিএসআইআর-এর গবেষক ত্রিস্রোতা চৌধুরী। গত ৪ মে 'নেচার' পত্রিকার প্রবন্ধে ওই গবেষণার কথা প্রকাশিত হওয়ার পরই আলোড়ন শুরু হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। ওডিশার চম্পুয়ায় গ্রানাইট আগ্নেয়শিলায় পাওয়া ওই খনিজের মধ্যে কি লুকিয়ে রয়েছে পৃথিবী সৃষ্টির আদি রহস্য? গনগনে লাভা স্রোত থেকে উঠে আসা এই খনিজের বৈশিষ্টই বা কী? বাঙালি বিজ্ঞানীদের হাত ধরেই কি খুলবে রহস্যের জট? সুদূর মালয়েশিয়া থেকে ই-মেলে আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তাঁর গবেষণার খুঁটিনাটি জানালেন রজত মজুমদার।

পৃথিবীর প্রাচীনতম খনিজ 'জ়ারকন'-এর খোঁজ নিয়ে চতুর্দিকে খুব আলোড়ন হচ্ছে। আপনি এই খোঁজের অন্যতম পথপ্রদর্শক, আপনার মতামত কী?

আমিই প্রথম নই যে এই বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছি। আইআইটি, সিএসআইআর হায়দরাবাদ, আইআইএসইআর (আমদাবাদ) ও বেঙ্গালুরু আইআইএসসি-তে এমন অনেক ভূবিজ্ঞানী এবং ভূবিশারদ রয়েছেন যাঁরা ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন। আমার মূল লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর অতল-অন্দরের প্রাচীন রহস্য ভেদ করা। ভূবিজ্ঞানের গবেষণাতেই উঠে আসবে সৃষ্টির আদিম পর্যায়ে পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং টেকটোনিক প্লেটের গঠন। আর এটা তো সবারই জানা যে, পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক গঠন সম্পর্কে বিশদে জানতে গেলে শিলার বিন্যাস খুব ভাল করে বুঝতে হবে। কারণ শিলার মধ্যেই সংরক্ষিত থাকে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগের নানা রহস্য। সেই থেকেই প্রাচীন শিলার খোঁজে আমার গবেষণা শুরু হয়।

 

বলা হচ্ছে, যে খনিজ পাওয়া গিয়েছে তার নাম 'জ়ারকন'। এই খনিজের বয়স নাকি ৪২৪ কোটি বছর। প্রশ্ন হল, জ়ারকনের বৈশিষ্ট্য কী? গবেষণায় কী ভাবে কাজে লাগছে এই খনিজ?

জারকন হল একপ্রকার রত্ন পাথর। নানা রকম রং ও আকারে পাওয়া যায় জ়ারকন। এর রাসায়নিক নাম জ়ারকোনিয়াম সিলিকেট (ZrSio4)। বহু বছর ধরে এই রত্নের উপর নানা পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ চলছে।

জ়ারকন পাওয়া গিয়েছে আগ্নেয়শিলার মধ্যে। ভূগর্ভের গলিত লাভাস্রোত বা ম্যাগমা যখন উপরে উঠে এসে জমাট বেঁধে আগ্নেয়শিলা তৈরি করে তখন তার মধ্যে অনেক খনিজ উপাদানই জমাট বেঁধে যায়, যার মধ্যে একটি হল জ়ারকন। তা ছাড়া জ়ারকন চাপ ও তাপ প্রতিরোধী। আগ্নেয়শিলার ক্ষয় হলেও এর ভিতরে থাকা জ়ারকন অবিকৃত থাকে, তাই এই খনিজের উপর গবেষণার কাজ অনেক সহজ।

 

কী ভাবে শুরু হল খোঁজ? ওডিশায় এই শিলার সন্ধান পেলেন কী ভাবে?

কলেজে পড়ার সময় থেকেই শিলা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। নানা বিজ্ঞানপত্রিকা নিয়ে নিয়মিত চর্চা করতাম। দুর্গাপুর গভর্নমেন্ট কলেজে পড়ার সময়েই বিহারের সিংভূম, ঝাড়খণ্ড ও ওডিশার নানা জায়গায় শিলার খোঁজে ঘোরাঘুরি করি। ২০০৬ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিউটে অধ্যাপনা করার সময়েই শিলার উপর গবেষণার কাজ শুরু করি। ২০০৯ সালে ইউনেসকো-র সহযোগিতায় পুরনো পাথর ও খনিজ সংগ্রহের কাজ শুরু করি। আমার ছাত্রী সিএসআইআর-এর গবেষক ত্রিস্রোতা চৌধুরী আমাকে এই কাজে সাহায্য করেন। ২০১০ সালে আমি আর ত্রিস্রোতা একসঙ্গে ওডিশার নানা জায়গায় অনুসন্ধানের কাজ শুরু করি। পরে ওডিশার চম্পুয়ায় গ্রানাইট আগ্নেয়শিলার মধ্যে এই জ়ারকনের খোঁজ পাই।




ওডিশার চম্পুয়ায়। (বাঁ দিক থেকে) ত্রিস্রোতা চৌধুরী ও রজত মজুমদার।

জ়ারকন থেকে কী ভাবে শিলার বয়স বার করা যাবে? শুধু জারকন কেন, অন্য খনিজ কেন নয়?

আগেই বলেছি, এই জ়ারকন আগ্নেয়শিলা গ্রানাইটের ভিতর পাওয়া গিয়েছে। গলিত লাভা যখন জমাট বেঁধে আগ্নেয়শিলায় রূপান্তিরত হয় তখন তার মধ্যে ইউরেনিয়াম, পটাসিয়াম, লেড-সহ একাধিক তেজস্ক্রিয় উপাদানও ঘনীভূত হয়ে থাকে। তেজস্ক্রিয় ডেটিং, অর্থাৎ ইউরেনিয়াম ও লেডের অনুপাত বিশ্লেষণ করে ওই শিলার বয়স জানা যায়। এই জ়ারকনের ভিতরে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থের অনুপাত থেকেই জানা গিয়েছে এই খনিজের বয়স প্রায় ৪২৪ কোটি বছর।

আগ্নেয়শিলার মধ্যে মোনাজাইট ও অন্যান্য অনেক সিলিকেট খনিজও থাকে, কিন্তু সবার মধ্যে জ়ারকনের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। বাইরের চাপ, তাপে শিলার ভিতর থাকা অন্যান্য খনিজের ক্ষয় হলেও জ়ারকনের বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয় না। ফলে, এই খনিজকে বিশ্লেষণ করে সহজেই জানা যায় ঠিক কত বছর আগে লাভা জমাট বেঁধে আগ্নেয়শিলাটি তৈরি হয়েছিল।

 

কেন মনে হল পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলা?

পূর্ব ভারতের এই পাথরের বয়স নিয়ে আগেও নানা রকম বিতর্ক হয়েছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূতত্ত্বের দুই শিক্ষক আশিসরঞ্জন বসু ও অজিতকুমার সাহা প্রথমে এই পাথরের বয়স ৩৮০ কোটি বছর দাবি করেছিলেন। সময়টা ১৯৮১ সাল। পরে নানা বিতর্কের মুখোমুখি হয়ে ১৯৯৫ সালে আমদাবাদের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক জে এন গোস্বামী ও অজিতকুমার সাহা দাবি করেন, ৩৮০ কোটি নয়, বরং শিলাটির বয়স ৩৫০ কোটি বছর। সুতরাং এই শিলাটি পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলার তালিকায় পড়ে না। কিন্তু, আমার মনে হয়েছিল প্রেসিডেন্সির অধ্যাপকেরা ঠিক শিলাই নির্বাচন করেছেন। আমি একটু অন্য পদ্ধতিতে পরীক্ষার কাজ চালাই এবং জানতে পারি ওই শিলা এবং জ়ারকন উভয়েরই উত্পত্তির কারণ গলিত লাভা বা ম্যাগমা। সেখান থেকেই পরে তেজস্ক্রিয় ডেটিং-এর মাধ্যমে শিলার বয়স নির্ণয় করা হয়।

এর আগে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় ৪৪০ কোটি বছরের পুরনো জ়ারকন খনিজের সন্ধান মিলেছিল, তা হলে পূর্ব ভারতে পাওয়া এই জ়ারকনটিকে প্রাচীনতম খনিজ বলা হচ্ছে কেন?

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক হিলে যে জ়ারকনের খোঁজ মিলেছিল সেটি মূলত পাললিক শিলার মধ্যে ছিল। পাললিক শিলার মধ্যে পাওয়া এই ধরনের জ়ারকনকে বলা হয় ডেট্রিটাল জ়ারকন। কিন্তু, ভারতে যে জ়ারকন পাওয়া গিয়েছে সেটি সরাসরি আগ্নেয়শিলা থেকে প্রাপ্ত। লাভা জমাট বেঁধেই এই শিলা ও খনিজের উত্পত্তি। এটিকে বলা হয় ম্যাগমাটিক জ়ারকন। ডেট্রিটাল জ়ারকনের মতো এটি কোনও রকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়নি। তাই বয়সের দিক থেকে অস্ট্রেলিয়ার জ়ারকন প্রাচীন হলেও ভূবিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী আগ্নেয়শিলা থেকে সরাসরি পাওয়া খনিজগুলির মধ্যে এই জ়ারকনই সবচেয়ে বেশি পুরনো। সে দিক থেকে বিচার করে এই খনিজকে বিশ্বের প্রাচীনতম খনিজ বলা হচ্ছে




ভূবিজ্ঞানী রজত মজুমদার জানালেন, আগ্নেয় গ্রানাইট শিলার মধ্যে প্রথম পাওয়া গেল এই খনিজ 'জ়ারকন'।  ​


আপনাদের আগে এই বিষয়ে আরও কী কী গবেষণার কাজ হয়েছে?

এর আগে কানাডার ভূবিজ্ঞানীরা ৪২০ কোটি বছরের পুরনো ম্যাগমাটিক জ়ারকনের খোঁজ পেয়েছিলেন। চিন ও ব্রাজিলের গবেষণায় উঠে এসেছিল ৪০০-৪১০ কোটি বছরের পুরনো জ়ারকন। কিন্তু, ওডিশায় এই প্রথম ৪২৪ কোটি বছরের পুরনো জ়ারকনের খোঁজ মিলল।

 

ভূবিজ্ঞানের কোন অজানা দিক উঠে আসবে এই গবেষণায়?

পৃথিবীর 'অন্দরমহল'-এ যে অজানা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, এই গবেষণা সেই অচেনা আঁধারেই নতুন আলোর দিশা দেখাচ্ছে। এই ম্যাগমাটিক জ়ারকন থেকে জানা যাচ্ছে, পৃথিবী সৃষ্টির আদিম পর্যায়ে ভূস্তরের ম্যান্টল থেকে গলিত লাভাস্রোত বেরিয়ে ভূত্বক বা ক্রাস্ট-এ এসে জমাট বেঁধে ওই শিলা তৈরি করেছে। সেই সময় ম্যান্টল ছিল পরিবর্তনশীল। বারে বারেই জমাট বাঁধা লাভা ভেঙেচুরে নানা ধরনের শিলায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই খনিজের বিশ্লেষণ ভূস্তরের গঠন সম্পর্কেও একটা নিশ্চিত ধারণা দেয়।

খনিজের অক্সিজেন আইসটোপ বিশ্লেষণ করে ভূপৃষ্ঠে প্রথম জলের উত্পত্তির ইতিহাস, টেকটোনিক প্লেটের চলন-সহ নানা দিক নিয়ে গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বলে আমি মনে করি।




চিনের শ্রিম্প সেন্টারের গবেষণাগারে  'সেন্সিটিভ হাই রেজলিউশন আয়ন মাইক্রোস্কোপ'।
এই যন্ত্রেই শিলা বিশ্লেষণ করে খনিজের বয়স বার করেছেন বিজ্ঞানীরা।

চিনের বিজ্ঞানীর সাহায্য কেন নিতে হল? ভারতেই কেন হল না এই গবেষণার কাজ?

এই শিলার বিশ্লেষণের জন্য যে যন্ত্রপাতির দরকার তা আমাদের দেশে নেই। শিলা বিশ্লেষণ করে খনিজের খোঁজ পেতে দরকার 'সেন্সিটিভ হাই রেজলিউশন আয়ন মাইক্রোস্কোপ' (SHRIMP)। শিলাটি নিয়ে গবেষণার জন্য আমি পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার, পার্থের ভূবিজ্ঞানীদের সাহায্য চাই। কিন্তু তাঁরা কোনও রকম সহযোগিতা করেননি। কানাডা ও জাপানের বিজ্ঞানীরাও শিলা নিয়ে পরীক্ষা করতে রাজি হননি। সেই সময় আমার সঙ্গে আলাপ হয় বেজিংয়ের শ্রিম্প সেন্টারের ভূবিজ্ঞানী ইউশেন ওয়ানের সঙ্গে। ইউশেন তাঁর গবেষণাগারে শিলার বিশ্লেষণ করে আমাকে সব তথ্য দেন। এই গবেষণার কাজও খুবই খরচসাপেক্ষ।

 

এই শিলার খোঁজ ভারতের গর্ব, কিন্তু বিজ্ঞানীদের গবেষণার জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে হয়। কী কী প্রযুক্তিগত ত্রুটি রয়েছে আমাদের দেশে?

ভারতের নানা জায়গায় এই রকম বহু মূল্যবান শিলার ছড়াছড়ি। এই সব শিলা সঠিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করলে ভূবিজ্ঞানের নানা তথ্য গবেষকদের হাতে আসবে। উপযুক্ত পরিকাঠামো এবং গবেষণার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে বেশির ভাগ পরীক্ষার কাজই এ দেশে করা সম্ভব হয় না। যেমন, পূর্ব ভারতে পাওয়া এই শিলার বিশ্লেষণের জন্য দরকার ছিল শ্রিম্প মেশিন যা ভারতে নেই। অথচ, আইআইএসসি বেঙ্গালুরু, সিএসআইআর, আইআইটি, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে ওই মেশিন বসানোর পরিকাঠামো রয়েছে। আমাদের এই গবেষণার সাফল্য ভবিষ্যতে ভারতে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করবে বলেই মনে করি।

তা ছাড়া এই গবেষণার কাজ খুবই ব্যয়বহুল। মহাকাশ গবেষণার কাজে অনেক টাকা খরচ করে সরকার। কিন্তু, ভূবিজ্ঞানের গবেষণা সেই দিক থেকে ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে। সরকারের কাছে আমার আর্জি, দেশে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে উঠলে ভূবিজ্ঞানের গবেষণায় আরও বেশি সাফল্য পাওয়া যাবে।

 

খোঁজ শুরুর আগে এবং পরে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কী? কতটা কঠিন ছিল এই আবিষ্কারের কাজ?

এই খোঁজ ছিল আমার স্বপ্ন। শুরু থেকে নানা বাধার মুখোমুখি হলেও আমি হার মানিনি। এই খোঁজ বর্তমানে সাড়া পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। আমেরিকা, নরওয়ের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়ে এগিয়ে আসতে চাইছেন। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল, চিনের নানা জায়গায় এই ধরনের শিলা নিয়ে গবেষণার কাজ চলছে। এই গবেষণাকে আমি আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ভবিষ্যতে আরও অনেক চমক দিতে পারব বলেই আশা রাখি।