সাইকেলের পিছনে ছুটে হেনস্থাকারীকে ধরলেন কলেজপড়ুয়া তরুণী পথেই যেন সিনেমা!



বুধবার ঘড়িতে তখন রাত ন'টা। দমদম অঞ্চলের এক জনবহুল রাস্তা। মাঝবয়সী এক সাইকেল চালকের পিছন পিছন দৌড়োচ্ছেন কলেজপড়ুয়া এক তরুণী।

ওই সাইকেলচালককে ধরতেই হবে। দৌড়োতে দৌড়োতে চিৎকার করছেন মেয়েটি। এ ভাবে প্রায় তিনশো মিটার দৌড়োলেন তিনি। শেষে রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া এক স্কুটারচালক মেয়েটিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সেই স্কুটারের পিছনে বসেই নতুন করে শুরু হল দৌড়। প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে 'হেনস্থাকারী' সেই সাইকেলচালককে হাতেনাতে ধরলেন তরুণী।  পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতের নাম প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। তাঁর বাড়ি দমদমে। অভিযোগ, তরুণীর উদ্দেশে পরপর তিন দিন কটূক্তি করেছেন তিনি। 

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সিঁথি এলাকার বাসিন্দা, ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী মৌমিতা দাস রোজ সন্ধ্যায় দমদম সেভেন ট্যাঙ্কস থেকে পাইকপাড়ার দিকে যাওয়ার রাস্তা ধরে জগিং করেন। অন্য দিনের মতো এ দিনও জগিংয়ের পরে বাড়ি ফিরছিলেন ওই তরুণী। পুলিশের কাছে মৌমিতার অভিযোগ, গত সোমবার চিৎপুর থানা এলাকার নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ে একটি রেস্তোঁরার কাছে এক মাঝবয়সী ব্যক্তি তাঁকে উদ্দেশ্য করে অশালীন ভাষায় মন্তব্য করে সাইকেল চালিয়ে চলে যান। ওই তরুণীর কথায়, ''প্রথম দিন ওই ব্যক্তির কথা শুনে বেশ 'শকড' হয়ে গিয়েছিলাম। এক জন মাঝবয়সী লোক আমাকে লক্ষ্য করে যে ওই ভাষায় কথা বলতে পারেন, তা দেখেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।'' অভিযোগ, মঙ্গলবার রাতেও ঘটে একই ধরনের ঘটনা। জগিং সেরে বা়ড়ি ফেরার সময়ে আবারও হেনস্থার শিকার হতে হয় ওই তরুণীকে। সে দিনও পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ওই মাঝবয়সী ব্যক্তি অশালীন ভাষায় কথা বলে সাইকেল চালিয়ে চলে যান বলে অভিযোগ। দ্বিতীয় দিনেও নীরব ছিলেন তরুণী। কিন্তু তৃতীয় দিন ফের একই হেনস্থার শিকার হতে হয় তাঁকে। একই সময়ে সেই মাঝবয়সী পুরুষের দেখা এবং অশ্লীল মন্তব্য। এ বার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে ওই তরুণীর।



১) সাইকেলে চেপে তরুণীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে প্রদীপ অশালীন মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ। 

২) চুপ করে না থেকে সাইকেলের পিছনে দৌড়তে শুরু করেন ওই তরুণী। 

৩) অভিযুক্ত তীব্র বেগে সাইকেল চালিয়ে একটি গলিতে ঢুকে পড়েন। তত ক্ষণে আশপাশের মানুষজনও বুঝতে পেরেছেন কী ঘটেছে। এক স্কুটার-চালক ওই তরুণীকে পিছনে বসিয়ে অভিযুক্তকে তাড়া করেন। 

৪) শেষমেশ ধরা পড়ে যান অভিযুক্ত। তরুণীকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয়েরাও। গ্রাফিক্স: প্রবাল ধর

এ দিন আর নীরব থাকেননি ওই কলেজপড়ুয়া তরুণী। মৌমিতার কথায়, ''প্রথম দু'দিন রাগ, যন্ত্রণাটা আমি আমার মনের মধ্যেই পুষে রেখেছিলাম। কিন্তু তৃতীয় দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। মনে হয়েছিল, এই ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে আমাদের নিজেদেরকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।''

রোজ সন্ধ্যায় নিয়মিত জগিং করতে বেরোন মৌমিতা। তাঁর কথায়, ''তৃতীয় দিন আমাকে উদ্দেশ্য করে ক়টূক্তি করে সাইকেল নিয়ে দ্রুত বেগে চলে যেতে দেখেই ওই ব্যক্তির পিছু নিই। আমাকে দৌড়োতে দেখে ওই ব্যক্তিও সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দেন। তখন আরও জোরে দৌড়োতে শুরু করি আমি।''

স্থানীয়েরা জানান, মৌমিতা দৌড়োনোর সময়ে চিৎকার করায় আশপাশের লোকজনও খেয়াল করেন ঘটনাটি। ছুটে আসেন তাঁরাও। বিপদ বুঝে অভিযুক্ত ওই ব্যক্তি প্রচণ্ড গতিতে সাইকেল চালিয়ে একটি গলির ভিতরে ঢুকে পড়েন। তখনই ওই স্কুটারচালক তরুণীর পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর স্কুটারে বসে কয়েকশো মিটার দূরে থাকা ওই ব্যক্তিকে ধরে ফেলতে সক্ষম হন মৌমিতা। ততক্ষণে অবশ্য স্থানীয়েরাও পথ আটকে ফেলেছিলেন প্রদীপের। 

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ধৃত ব্যক্তিকে ধরে ফেলে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রচণ্ড মারধর শুরু করেন। ঘটনার খবর পেয়ে চিৎপুর থানার পুলিশ গিয়ে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত প্রদীপ পেশায় দিনমজুর। তাঁর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা রুজু করা হয়েছে।



অকুস্থল: দমদম নর্দার্ন অ্যাভিনিউ। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়েই তরুণীকে কটূক্তি করা হয় বলে অভিযোগ। নিজস্ব চিত্র

এ ভাবে ধাওয়া করে 'হেনস্থাকারীকে' ধরে ফেলায় মৌমিতার প্রশংসা করছে পুলিশও। কলকাতা পুলিশের ডিসি (উত্তর) দেবাশিস সরকার বলেন, ''মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক কোনও ঘটনা ঘটলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা বলার সাহস পান না। বুধবারের ঘটনায় ওই তরুণী যে সাহস দেখিয়েছেন, তাতে অন্যদেরও শেখা দরকার। পাশাপাশি, অভিযুক্তকে ধরার পিছনে ওই স্কুটারচালকের অবদানও কম নয়।''

এই ঘটনা প্রসঙ্গে মৌমিতার বক্তব্য, ''আমার মতো অনেক মেয়েকেই নিয়মিত এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আমার একটাই কথা, এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তৎক্ষণাৎ রুখে দাঁড়াতে হবে। ওই স্কুটারচালক দাদাকে ধন্যবাদ। আমার পাশে তিনি ছিলেন বলেই অভিযুক্তকে হাতেনাতে পাকড়াও করতে পেরেছি।''