সংরক্ষণ তো হল, প্রয়োজনে মিলবে কি


'সুযোগ চলে গেলে আর আসবে না'। 'হয় এ বার, নয় নেভার'। 'এক বার বিনিয়োগে জীবনভর সুরক্ষা'।

সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর প্রসবের তারিখ চিকিৎসকেরা বলে দেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের পাঠানো এই মেসেজগুলি পাচ্ছিলেন মানিকতলার পল্লব হালদার। এক রক্ত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বিস্তর আলোচনার পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সংরক্ষণ করাবেন না। পল্লববাবু বলেন, ''মেসেজ করে, ফোন করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। বলছে, ২৫ বছরের মধ্যে প্রয়োজন পড়লেই কর্ড ব্লাড কাজে লাগবে। ওই রক্তের প্রচুর উপকার মানছি। কিন্তু এত টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কে রক্ত রাখব! ব্যাঙ্কটা ২৫ বছর থাকবে তো?''

শুধু ওই ব্যক্তিই নন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি নিয়ে সংশয়ে ভুগছেন গ্রাহকদের একটি বড় অংশ। ব্যাঙ্কগুলির স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ে চিকিৎসকেরাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, ইউরোপ, আমেরিকায় কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ হয় নিয়ম মাফিক। প্রশিক্ষিত কর্মীরা শিশুর জন্মের সময়ে কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করেন। এ নিয়ে প্রচুর নজরদারিও রয়েছে। তবে অভিযোগ এখানে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে নজরদারি তো দূর, সে ভাবে কোনও নিয়মই নেই। এক চিকিৎসকের কথায়, ''শিশুর জন্মের পরে কোন সময়ে কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করতে হয়, কত উষ্ণতায় তা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা তা জানেনই না। কোথায় সেই রক্তের প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে, তা নিয়েও কারও মাথা ব্যথা নেই। ফলে কিছু না জেনেই কর্ড ব্লাড নিয়ে ব্যবসা করছেন অনেকে।''

হেমাটো অঙ্কোলজিস্ট দেবমাল্য ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, জন্মের আগে শিশুর সঙ্গে তার মায়ের যোগ থাকে নাড়ি বা আম্বিলিকাল কর্ডের মাধ্যমে। তাঁর কথায়, ''একেই মায়ের সঙ্গে শিশুর নাড়ির যোগ বলে। ওই আম্বিলিকাল কর্ডের মধ্যে ৫০০ থেকে ৭০০ মিলিলিটার রক্ত থাকে। সেই রক্তে আছে স্টেম সেল। ওই রক্তই কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কে সংরক্ষণ করা হয়।'' দেবমাল্যবাবু জানান, এই স্টেম সেল রক্তের আদি কোষ। স্নায়ুর সমস্যা থেকে শুরু করে যে কোনও জটিল ব্যাধির চিকিৎসায় কর্ড ব্লাড ব্যবহার করা হয়। তাঁর কথায়, ''ব্লাড ক্যানসারের চিকিৎসায় কর্ড ব্লাড রোগীর দেহে নতুন রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।''

তিনি জানান, শিশুর জন্মের পরে আম্বিলিক্যাল কর্ড থেকে রক্ত নিয়ে তা প্রক্রিয়াকরণের পরে ৮০ থেকে ১৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় তা সংরক্ষণ করতে হয়। আর এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শিশুর জন্মের পরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই শেষ করে ফেলতে হয়। দেবমাল্যবাবু বলছেন, ''এই নিয়মের হেরফের হলে কর্ড ব্লাডের গুণমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।''

দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে চিকিৎসার কাজে যুক্ত গাইনি অঙ্কোলজিস্ট মানস চক্রবর্তী বলছেন, ''ইংল্যান্ডে দেখেছি, কর্ড ব্লাড নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে। ব্যবসায়ীদের জন্য কঠোর নিয়ম রয়েছে। আমাদের এখানে গবেষণা হলেও নজরদারির খুব অভাব। এখানে কোনও সরকারি নিয়মই নেই। কে, কী ভাবে রক্ত সংগ্রহ করছে বা রাখছেন, সেটা কে দেখবেন?'' ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ও জোর দিয়েছেন নিরন্তর নজরদারির উপরে। তাঁর কথায়, ''আধুনিক চিকিৎসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটিতে স্বচ্ছতা এবং যথাযথ পরিকাঠামো না থাকলে উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হতে পারে।''

কী বলছে ব্যাঙ্কগুলি? একটি কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের কলকাতা শাখার ম্যানেজার পিকলু সাহা বলেন, ''আজীবন কর্ড ব্লাড সংরক্ষণে আমরা ৬৫ হাজার টাকা নিই। আমাদের কর্ড ব্লাড কমিউনিটিও আছে। যেখানে এক জনের কর্ড ব্লাড অন্যকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। নিয়ম মেনেই কাজ করি।'' তাঁদের কর্মীরা প্রশিক্ষিত কি না বা রক্ত সংরক্ষণের নিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁর জবাব, ''আমরা একটি মাপকাঠি বজায় রাখি।'' এ জে সি বসু রোডের একটি কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের সিইও উপমন্যু রায়চৌধুরী জানান, কর্ড ব্লাড রাখতে ২১ বছরের জন্য এককালীন ৫৫ হাজার টাকা নেন। তাঁর কথায়, ''সংস্থার স্বার্থেই মান নিয়ে আপস করি না। তা ছাড়া সরকারি নজরদারিও চলে। সরকারি নিয়ম পাকাপোক্ত হলে আমাদেরই ভাল।'' সরকারি ভাবে কর্ড ব্লাড নিয়ে গবেষণায় যুক্ত চিকিৎসক নিরঞ্জন ভট্টাচার্যও বলছেন, ''একটা মান বজায় রাখতে হয়। না হলে ব্যাঙ্কগুলির লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেতে পারে।'' 

কিন্তু কর্ড ব্লাডগুলিতে নজরজারির জন্য কী নিয়ম রয়েছে, তা নিয়ে কার্যত অন্ধকারে স্বাস্থ্য দফতর। দফতরের অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ''বিষয়টি ঠিক ভাবে জানা নেই। ভাল ভাবে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।''