এর নাম ভোট!


গণতন্ত্রের কফিনে ৩৪ শতাংশ পেরেক বাংলা আগেই পুঁতে ফেলেছিল। সেই পেরেকগুলো কফিনে থাকবে কি না, তা এখন আদালতের বিচারাধীন ঠিকই। কিন্তু সে সবের পরোয়া না করেই বাকি ৬৬ শতাংশ পেরেকও ঠুকে দেওয়ার চেষ্টা হল ভোটের দিনে।

হিংসার পূর্ণগ্রাস বললে একটুও অত্যুক্তি হয় না। বুথ দখল করা, বিরোধী দলের এজেন্টকে বার করে দেওয়া, আগ্নেয়াস্ত্রের নলের মুখে ভোটকর্মীদের শাসানো, অবাধে ছাপ্পা ভোট দেওয়া— এ সব তো রইলই। কিন্তু তাতেই সীমাবদ্ধ রইল না সন্ত্রাস। ভোটকেন্দ্রের ভিতরে যতখানি দাপট দেখাল শাসক দল, তার চতুর্গুণ বা দশগুণ বা জানা নেই কতগুণ সন্ত্রাস কায়েম করা হল ভোটকেন্দ্রের বাইরে থাকা দিগন্তজোড়া গ্রামীণ বাংলায়।

পুলিশ-প্রশাসন ঠুঁটো বললে কমই বলা হয়। অবাধে চলল হিংসার উন্মত্ত উল্লাস। মনোনয়ন পর্বে সন্ত্রাসের অবয়বটা তো স্পষ্ট হয়েই গিয়েছিল। ভোটের দিনে দাঁত-নখগুলো আরও তীক্ষ্ণ হয়ে বেরিয়ে পড়ল যেন। বিরোধিতার যে কোনও রকম অস্তিত্ব দেখলেই শাসকের বাহিনী কেমন এক অমানুষিক আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ফলাফল সবার চোখের সামনে। গণতন্ত্রের উৎসবের দিনের প্রতি ঘণ্টায় লাফিয়ে বাড়ল মৃত্যুর সংখ্যা। জখম-রক্তাক্ত হলেন আরও বহু। লাঞ্ছিত-অপমানিত-বিধ্বস্ত হলেন কত অসংখ্য, সে হিসেব নিতে গেলে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে শ্রদ্ধা চলে যেতে পারে।

কীসের গণতন্ত্র? কেন এই নির্বাচন নামক প্রহসনের আয়োজন? এই ভোট দেখলে ধারণা দৃঢ়মূল হয় যে, ভারতীয় গণতন্ত্রে নাগরিকের সর্বাত্মক অংশিদারিত্বের যে তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে, তা আদ্যোপান্ত আজগুবি। রাষ্ট্রক্ষমতা বা প্রশাসন যাঁর হাতে, তিনি চাইলে নাগরিককে অংশ নিতে দেবেন, না চাইলে দেবেন না। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ-প্রশাসন, রাজনৈতিক শিবির— কারও কিচ্ছু করার নেই, সবই যেন ক্ষমতাসীনের ক্রীড়ণক।

এ কথা ভাবার পরমুহূর্তেই অবশ্য মনে হয়, গোটা ভারতকে দোষী ঠাউরে লাভ নেই, সে উচিতও নয়। সমস্যা আমাদের নিজেদের ঘরেই। যে ভাবে নির্বাচন হয় এই বাংলায়, গত কয়েক বছরে যে ভাবে হচ্ছে বিশেষত, তেমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন ভারতের আর কোনও রাজ্যে বা কোনও প্রান্তেই হয় না আজকাল আর।

আগে কি তা হলে সমস্যা ছিল না বাংলার নির্বাচন ঘিরে? প্রশ্ন উঠতেই পারে। বাম জমানায় ভোটের নামে অবাধে ভোট লুঠ হয়নি? রাজ্যের বেশ কিছু প্রান্ত নির্বাচনী সন্ত্রাসের জন্য কুখ্যাত ছিল না সে সময়ে?

সঙ্গত প্রশ্ন। উত্তরও সকলেরই জানা। বাম জমানাতেও নির্বাচনী সন্ত্রাস দেখেছে বাংলা। বাম জমানাতেও ভোটকে প্রহসনে পরিণত করার প্রক্রিয়া দেখা গিয়েছে। সে সময়েও  একাধিক নির্বাচনে বাংলা রক্তাক্ত হয়েছে। কিন্তু সে জমানায় নির্বাচনী সন্ত্রাস কি এই রকম বল্গাহীন-অনিয়ন্ত্রিত ভাবে নেমে আসত। রাজ্যের যে প্রান্তেই তাকানো হবে, সেখান থেকেই কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশের দিকে উড়তে দেখা যাবে, সেখান থেকেই নাগরিকের অসহায় আর্তনাদ ভেসে আসবে— এমনটা কি ছিল সে সময়ের পরিস্থিতি?

সে সময়ের পরিস্থিতি ভাল ছিল, নাকি সেই অভ্যাসেরই হুবহু পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে, সে প্রশ্ন অবশ্য গৌণ। মুখ্য প্রশ্ন অন্য। মুখ্য প্রশ্ন হল, আজকের একটা অপরাধ কি ভবিষ্যতে আরও বড় অপরাধের সংঘটনকে বৈধতা দেয়?  বাম জমানায় যা হচ্ছিল, তার পরিবর্তনই তো চাওয়া হয়েছিল। সে সময়ে নির্বাচনগুলিকে প্রহসন আখ্যা দিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব তো আজকের শাসকরাই হতেন। বামেদের 'গণতন্ত্রের হত্যাকারী' আখ্যা দিয়ে সরকারের উত্খাতের ডাক তো তত্কালীন বিরোধী তথা আজকের শাসক দলই দিয়েছিল। তা হলে সে জমানার নেতি আজ কয়েক গুণ প্রাবল্যে পুনরাবৃত্ত হবে কেন?

আবার বলি, পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে যা দেখতে হল বাংলায়, তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর থেকে শ্রদ্ধা চলে যেতে পারে। গণতন্ত্রের সম্মান আক্ষরিক অর্থেই ভূলুণ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। এমন এক রাজনৈতিক শক্তির হাত ধরে সে ঘটনা ঘটল, যারা বিরোধী আসনে থাকাকালীন 'গণতন্ত্র, গণতন্ত্র' বলেই সবচেয়ে বেশি সরব ছিল। বাংলায় গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে এর পর অন্যান্য দল যখন সরব হবে, তখন তাদের উপরে ভরসা রাখা যাবে কী ভাবে? এমন প্রশ্নও তুলে গিয়ে গেল এই পঞ্চায়েত নির্বাচন।