এ বার ভোটে বেশি নিরাপত্তা রক্ষী? অঙ্কের কাঁচা খেলা খেলছে রাজ্য


নিরাপত্তার জটেই ফের আটকে রইল পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভাগ্য। পাঁচ বছর আগেও একই ভাবে নিরাপত্তা ইস্যুতেই আটকে গিয়েছিল ভোটের প্রক্রিয়া। পার্থক্য শুধু একটাই...

২০১৩ সালে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার দাবি নিয়ে, রাজ্য সরকারের সঙ্গে সম্মুখ সমরে গিয়ে, সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত ছুটেছিলেন খোদ নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। আইনি লড়াই করে আদায় করে নিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনী।

আর পাঁচ বছর পর, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে, রাজ্যের প্রস্তাবিত নিরাপত্তা নিয়ে একবিন্দু অভিযোগ নেই কমিশনের। যদিও তা এখনও আদালতকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ। আদালতে রাজ্য সরকারের অবশ্য দাবি, ২০১৩-র নির্বাচনের থেকে অনেক বেশি সংখ্যক নিরাপত্তা কর্মীর বন্দোবস্ত করা হয়েছে এই বছর। কিন্তু আদৌ কি তাই? না পুরোটাই অঙ্কের খেলা?



২০১৩ সালে প্রথমে তিন দফায় নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছিল। আর সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রায় আড়াই লাখ বাহিনীর দাবি করেছিলেন তখনকার নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। এ বারের মতোই রাজ্যের পক্ষ থেকে হোমগার্ড, এনভিএফ, সিভিক পুলিশ মিলিয়ে এক জোড়াতালির নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল কমিশনকে। এ বার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বাহিনীর দক্ষতা ও মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, সেই সময় নির্বাচন কমিশনারই সেই বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে না পেরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি তুলেছিলেন।

২০১৩ সালে শেষ পর্যন্ত তিন দফার নির্বাচন পাঁচ দফায় করার নির্দেশ দেয় আদালত। নির্বাচনের জন্য রাজ্যে পাঠানো হয় তিনশো কোম্পানি, অর্থাত্ প্রায় ৩০ হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী। আর রাজ্যকে প্রতি দফায় ৩৫ হাজার সশস্ত্র পুলিশ দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। অর্থাৎ প্রতি দফায় গড়ে পঞ্চান্ন-ষাট হাজার সশস্ত্র বাহিনী পেয়েছিল কমিশন। এ বার সেই সংখ্যাটা ৭১,৫০০।

এই সংখ্যা দেখিয়েই মঙ্গলবার আদালতে রাজ্যের দাবি, গত বারের থেকে বেশি বাহিনী নামানো হচ্ছে এ বার। কিন্তু বাস্তব অঙ্কটা কী? গত পঞ্চায়েত ভোটে ৫ দফার প্রত্যেকটিতে কাজ করেছে প্রায় ৬০ হাজার করে বাহিনী। সব মিলিয়ে কার্যত কাজ করেছে তিন লক্ষের মতো বাহিনী।



প্রাক্তন পুলিশ কর্তা পঙ্কজ দত্তও এ কথাই বলছেন, "মাথায় রাখতে হবে (গত ভোটে) ওই সংখ্যক (৬০ হাজার) নিরাপত্তা রক্ষী গোটা রাজ্যে মোতায়েন করা হয়নি। এক একটি দফায় তিনটি বা চারটি জেলায় নির্বাচন হয়েছে। আর এ বার বাহিনী মোতায়েন করা হবে এক দিনে কুড়িটি জেলায়। বুথ বা ভোটার প্রতি নিরাপত্তা রক্ষীর সংখ্যা ২০১৩-র থেকে ২০১৮-তো অনেক অনেক কম।"

রাজ্য আদালতে যে তথ্য জমা দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে প্রতি বুথে এক জন করে সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা হবে। সঙ্গে থাকবেন লাঠিধারী আরও একজন। সেই হিসেব মেনে চললেও রাজ্যের আটান্ন হাজারের কিছু বেশি বুথে এক জন করে সশস্ত্র রক্ষী দিলে সেখানেই মোতায়েন করতে হবে মোট সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ৮২ শতাংশ। বাকি হাতে থাকবে প্রায় তের হাজার বাহিনী। আদালতে দেওয়া তথ্য অনুসারে, বুথ ছাড়াও ওই বাহিনীকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হবে। রাজ্যের বয়ান অনুযায়ী— সেক্টর মোবাইল ফোর্স, আর টি মোবাইল ফোর্স, কুইক রেসপন্স টিম, হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড, স্ট্রাইকিং ফোর্স, স্ট্রং রুম এবং ব্যালট বণ্টন ও গ্রহণ কেন্দ্রেও এই সশস্ত্র বাহিনীকে মোতায়েন করা হবে। মাত্র তের হাজার সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মীকে দিয়ে এই বিপুল আয়োজন আদৌ কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের একাংশেরই। এই বন্দোবস্ত আদৌ বাস্তব সম্মত নয়, মত পঙ্কজ দত্তর। তিনি বলেন, "নিয়ম অনুসারে কোথাও এক জন করে সশস্ত্র পুলিশ কর্মী মোতায়েন করা যায় না। ন্যুনতম দু'জন করতে হবে।"



রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা, যিনি এর আগে কলকাতা পুলিশেও পুর নির্বাচন সামলেছেন, আরও কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, "প্রতি বুথে এক জন করে সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করা হবে, এ রকম কখনই সম্ভব নয়। কারণ নির্বাচনের সময়, রাজ্য এবং কমিশন বুথের চরিত্র অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করে। অতি স্পর্শকাতর বা উত্তেজনা প্রবণ, স্পর্শকাতর, কম উত্তেজনা প্রবণ এবং সাধারণ। এই চরিত্রগত প্রকার ভেদের পরই ঠিক হয় কোন বুথে কত নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করা হবে। প্রতি বুথে ন্যুনতম এক জন সশস্ত্র রক্ষী রাখার সিদ্ধান্ত নিলে, এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, অতি উত্তেজনা প্রবণ এবং উত্তেজনা প্রবণ বুথে একাধিক সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মী রাখতে হবে।" নিরাপত্তার এই প্রাথমিক সূত্র মানলে, ৭১,৫০০ জন সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষীকে দিয়ে আদৌ নির্বাচন সামলানো সম্ভব নয় বলেই মত একাধিক পুলিশ কর্তার।



আর তাই রাজ্যর দেওয়া নিরাপত্তার খতিয়ান যে সংখ্যার খেলা— আদালতে বিরোধীদের এই অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয়, তা সংখ্যাই প্রমাণ করছে।