একশো দিনের কাজের অনুপযুক্ত রূপায়ণই কি শাসকদলের আশঙ্কার কারণ?


মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের (এমজিএনআরইজিএ) গোড়াপত্তন ২০০৫-এ তত্কালীন ইউপিএ সরকারের হাত ধরে| এটির সূচনা ভারতে ঐতিহাসিক ভাবে তাত্পর্যপূর্ণ। কারণ, এই সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্পটি গ্রামাঞ্চলে পরিবার পিছু একশো দিনের কাজে চলতি কৃষিমজুরি দরের অধিক দর সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই নেওয়া হয়েছিল এবং শুরু থেকেই এই প্রকল্পটির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে| এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠতে পারে, ২০০৫-এ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৯% হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা কেন জরুরি হয়ে পড়েছিল? এর স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কারণগুলির মধ্যে একটি কারণ, তত্কালীন কৃষিক্ষেত্রের (বৃদ্ধির হার: ১৯৯৫-'৯৬: -০.৯৮ থেকে ২০০৩-'০৪: -৮.১৪) কোনও বৃদ্ধিই হয়নি, বরং তা ছিল ক্রমশই হ্রাসমান ও কর্মসংস্থানের (বৃদ্ধির হার: ১৯৯৩-'৯৪ ও ২০০৪-'০৫: ২.৬২) বৃদ্ধির হার একই ছিল এবং গ্রামাঞ্চলের বিপুল জনসংখ্যার অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছিল, অর্থাত্ অর্থনীতি দ্রুত ক্রমবর্ধমান হলেও সামগ্রিক ভাবে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল সর্বত্র পৌঁছয়নি (তথ্য: যোজনা কমিশন, ভারত সরকার)| উপরোক্ত পরিস্থিতিতে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান বাড়ানো অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে এবং এটিই ইউপিএ সরকারের একশো দিনের কাজ প্রকল্পের প্রবর্তনের একমাত্র কারণ হতে পারে| পরবর্তীকালে অবশ্য বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এই প্রকল্পের দ্বারা গ্রামীণ পরিকাঠামো তৈরির মাধ্যমে গ্রামোন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন| অতএব, অল্প সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সব রাজনৈতিক দলের কাছে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য একটি মুখ্য হাতিয়ার হয়ে ওঠে|

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে উভয় শাসকদলই (যথাক্রমে সিপিআইএম ও তৃণমূল কংগ্রেস) একশো দিনের কাজ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে অক্ষম

প্রথম বর্ষ বাদে, একশো দিনের কাজে তহবিলের ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হলেও সিপিএম সরকার মোট কর্মদিবস সৃষ্টিতে তৃণমূল সরকারের তুলনায় পিছিয়ে ছিল (টেবিল দ্রষ্টব্য)| উপরন্তু সে সময় পশ্চিমবঙ্গে একশো দিনের কাজে দৈনিক মজুরি অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় যথেষ্ট কম ছিল, মধ্যপ্রদেশ-৯১ টাকা, ত্রিপুরা-৮৫ টাকা, পশিমবঙ্গ-৭৫ টাকা (তথ্য: MGNREGA ওয়েবসাইট)| এককথায় সিপিএম সরকার এই প্রকল্পের তহবিল বণ্টনে এবং কর্মদিবস সৃষ্টিতে সফল হয়নি|

২০১১-এ তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পশ্চিমবঙ্গে একশো দিনের কাজ প্রকল্পের চিত্র বদলে যেতে থাকে, এই প্রকল্পের তহবিলের ব্যবহার ও মোট কর্মদিবস ব্যাপক ভাবে বাড়তে থাকে| তাই এই প্রকল্পের তথাকথিত সাফল্যকে ২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল সরকারের বিপুল জয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করা যেতে পারে| যদিও তৃণমূল সরকার এই প্রকল্পের তহবিলের ব্যবহার ও মোট কর্মদিবস ব্যাপক ভাবে বাড়াতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু সমাপ্ত হওয়া কাজের শতকরা হার বহুলাংশে কমে যায়| আর্থিক বর্ষ ২০১৬-'১৭-তে এই প্রকল্পের তহবিলের ব্যবহার ৯৫% হলেও সমাপ্ত হওয়া কাজের শতকরা হার ছিল মাত্র ১.৫৮! অন্য দিকে, ২০১৭-'১৮ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ আবার ৩১২৫.৫৫ লক্ষ কর্মদিবস সৃষ্টি করে ভারতে প্রথম স্থান অধিকার করে (তথ্য: এমজিএনআরইজিএ ওয়েবসাইট)| উপরে উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে তহবিলের ব্যবহার ও একশো দিনের কাজের মধ্যের অসঙ্গতিকে খুব সহজেই বোঝা যায়|

পরিসংখ্যান (টেবিল দেখুন) অনুযায়ী, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন যতই এগিয়ে আসে পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্পের গড় মজুরি ক্রমশ বাড়ে। যা থেকে মনে হয় এটা যেন শুধুই কেন্দ্রের টাকা গ্রামের মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার একটা মাধ্যম| অন্য দিকে, এই প্রকল্পের গড় মজুরি আবার কৃষিক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরির থেকে অনেক কম, অর্থাৎ, বর্তমান সরকার কৃষি মজুরির দরের চেয়ে অধিক দরে একশো দিনের কাজ দিতে অসফল| উপরন্তু, সমাপ্ত হওয়া কাজের পরিসংখ্যান গ্রামাঞ্চলে সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে না এবং দীর্ঘমেয়াদি গ্রামীণ পরিকাঠামো গড়ে তোলার পথও নির্ধারণ করে না| তাই পরিসংখ্যান দ্বারা অতিরঞ্জিত একশো দিনের কাজ প্রকল্পের অকার্যকরী ও অনুপযুক্ত রূপায়ণই কি শাসকদলের আশঙ্কার অন্যতম কারণ?