‘পুঁতেছিলাম ঘাস, হয়ে গেছে বাঁশ’, শাসকের বিরুদ্ধে এটাই কি স্লোগান জঙ্গলমহলের?


বাঁকুড়ার খাতড়া মহকুমার অম্বিকানগর গ্রাম পঞ্চায়েত জিতেছে তৃণমূল কংগ্রেস। মুকুটমণিপুরের ধার ঘেঁষে এগোলে অম্বিকাদেবীর প্রাচীন মন্দির। এ চত্বরে মা অম্বিকাই সর্বশক্তিময়ী। লোকমুখের কথা হল, মায়ের থানে আর কোনও অধিপতি নেই।

রাজনীতির চক্করে তা বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন রানিবাঁধের যুব তৃণমূল নেতা বিদ্যুৎ দাস। পঞ্চায়েত ভোটের দিনে লদ্দা গ্রাম তাঁকে কিঞ্চিৎ 'লোকশিক্ষে' দিয়েছে। রুইদাস, সর্দার, মাহাতো, শবরদের গ্রাম লদ্দায় এ বার জিতেছে বিজেপি। কিন্তু এখানে জেতার কথা ছিল শাসক দল তৃণমূলেরই। কারণ, এই গ্রাম বরাবরই তৃণমূলের, সেই বাম জমানা থেকেই। তা হলে কেন এই উলটপুরাণ? বলছিলেন আশুতোষ সর্দার। ওই গ্রামের ২০ বছরের তৃণমূল কর্মী। তিনি জানান, শান্তিতেই ভোট হচ্ছিল।

এ বার রুইদাস আর মাহাতোরা বিজেপিমুখো হলেও জেতা নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। বেলা গড়াতেই গ্রামে বাইক বাহিনী ঢুকল। শুনলাম আখখোটার বিদ্যুৎ দাস ছাপ্পা বাহিনী নিয়ে এসেছেন। মহিলারাই তখন লাইনে। বুথের সামনে দাঁড়াল সেই বাহিনী। বুথ দখল করতে এগোলে রুখে দাঁড়ায় বিজেপি। সঙ্গে গ্রামের প্রায় সব মানুষ। জ্বালিয়ে দেওয়া হল দু'টো গাড়ি। তেড়ে যাওয়া হল। বাইক-বাহিনী পিছু হঠল। কিন্তু গোলমালের জেরে ফের ভোট নেওয়ার নিদান দিল নির্বাচন কমিশন। ফিরতি ভোটে তৃণমূল আর দাঁড়াতে পারেনি। শুধু লদ্দা নয়, পাশের ঠুঁটাশোল আর ডাবরিও বিজেপি জিতে নিয়েছে।

আশুতোষবাবুর আক্ষেপ, ''কী দরকার ছিল? আমাদের গ্রামে মিলেমিশে ভোট হয়। জবরদস্তি করতে গিয়ে হারলাম। আমি তৃণমূল করলেও এ সব সমর্থন করি না। এখন বিজেপির মারের ভয়ে আমাদের কর্মীরা ঘরছাড়া, আর পুলিশের ভয়ে বিজেপির কর্মীরা।'' লদ্দার ভোলানাথ সর্দার বিজেপি সমর্থক। তাঁর আশঙ্কা, ''এখনই যদি গাঁয়ের মেয়েদের বন্দুক দেখিয়ে ভোট আটকায়, জিতলে কী করত? সেই কারণেই মানুষ প্রতিরোধ করেছে।'' প্রতিরোধের মুখে যাঁর গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই বিদ্যুৎ দাসের বক্তব্য, ''আমি ভোট দেখতে গিয়েছিলাম।  বিজেপি ষড়যন্ত্র করে হামলা চালিয়েছে। আমার সঙ্গে কোনও ছাপ্পা বাহিনী ছিল না।'' বাহিনী থাকা বা না থাকার বিতর্কের মধ্যে যা হয়েছে তা হল, অম্বিকা নগরে তৃণমূলের জেতা বুথে এ বার জিতেছে বিজেপি।

লদ্দা একটা উদাহরণ মাত্র। রানিবাঁধের পুনশ্যা গ্রামও একই ঘটনার সাক্ষী। টুরা পাহাড়ের পথে ঘন জঙ্গল, ঢালাইয়ের রাস্তা, গ্রামে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা ছড়ানো তথ্যমিত্র কেন্দ্র পেরিয়ে যায় পর পর। কদমাগড়ের মতো পাহাড়ি চৌরাস্তাও এখন অনেক বেশি জমকালো। প্রত্যন্ত পুনশ্যার অজিত মুর্মু চেয়েছিলেন বিজেপির প্রতীকে ভোটে লড়তে। মুর্মু পরিবারের আগের প্রতীক ছিল কাস্তে-হাতুড়ি-তারা। অভিযোগ, 'উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে' থাকায় মনোনয়ন দিতে পারেননি অজিত। তাঁর ভাই অসিতের কথায়, ''মনোনয়ন জমা দিতে না পারায় দাদা দলবল নিয়ে বাজারে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। সেখানে হামলা হয়। মারা যায় দাদা।'' পরে সেই বুথে আর প্রার্থী দেয়নি বিজেপি। বিনা লড়াইয়ে জিতেছে তৃণমূল। কিন্তু পুনশ্যা গিয়ে দেখা গেল, পুরো গ্রাম বিজেপি পতাকায় ছেয়ে রয়েছে। বাংলা আবাস যোজনায় সদ্য তৈরি হওয়া বাড়িতেও উড়ছে পদ্ম-পতাকা। অসিত বললেন, ''খুনের পর এ গ্রামে আর কেউ জোড়াফুলের কথা ভাবে না।''

ফেরার পথ ছিল দুবরাজপুরের উপর দিয়ে। এই দুবরাজপুর মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পালের ভোট কেন্দ্র। তাঁর বাড়ি লাগোয়া খেজুরখন্না গ্রাম হলেও পুলিশি নজরদারিতে থাকা রঞ্জিত ভোট দেন এখানে। এলাকার লোকজন জানালেন, পুলিশ পাহারায় এখানে প্রচারে এসেছিলেন রঞ্জিত। জোড়াফুলের পক্ষেই বলেছিলেন। বুথটি উল্টে গিয়েছে।  রঞ্জিত নাকি গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রামের ভুলাভেদা-চিরুগোড়াতেও। পুরো গ্রাম প়ঞ্চায়েতটাই হেরে গিয়েছে তৃণমূল। মাওবাদীদের হাতে ২০০৯-এ ভুলাভেদায় খুন হয়েছিলেন সিপিএম নেতা অসীম মণ্ডল। ১৫ দিনের মধ্যে আরও তিন জন খুন হয়েছিলেন— দুর্গা দেশওয়ালি, সন্তোষ মাহাতো এবং শঙ্কর টুডু। নিহত অসীমবাবুর ছেলে অম্লান এখন বাবার জুতোর দোকান চালান। তাঁর মতে, ''যারা আমার বাবাকে খুন করেছিল, তারাই এখন শাসক। পুলিশ পাহারায় তাদেরই একজন প্রচারে এল। আমরা মেনে নেব? ভুলাভেদা কিন্তু চমকানি-ধমকানিতে ভয় পায়নি।''        

ভুলাভেদার মতো পুরুলিয়ার বেলা গ্রামও দেখিয়েছে হুমকি-হামলা দিয়ে আদিবাসী এলাকার দখল নিতে গেলেই 'ছ্যাঁকা' খেতে হয়েছে শাসক দলের 'উন্নয়নবাজদের'। পুরুলিয়ার বেলা গ্রামে জিতেছেন বিজেপির সুভাষ হাঁসদা। ভোটের আগে এই গ্রামেরই বিজেপি সমর্থক জগন্নাথ টুডুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যুই বিরামডি স্টেশন লাগোয়া পুরো গ্রাম পঞ্চায়েতের ফল বদলে দিয়েছে। সুভাষের বক্তব্য, ''ভেবেছিল, মেরে ঘরে ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু মানুষ এককাট্টা হয়ে হারিয়ে দিয়েছে।''

এককাট্টা হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বীরভূমের মহম্মদবাজারের টা‌ঙশুলিগ্রামেও। এই গ্রাম থেকেই আদিবাসীরা তীর-ধনুক-বল্লম নিয়ে বিডিও অফিসে গিয়েছিলেন। সেই 'প্রতিরোধ' সামলাতে পারেনি শাসক দল। মনোনয়ন দাখিল হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, তারপর ১০ হাজার ৫৬ জনের নামে মামলা দায়ের করেছিল পুলিশ। অভিযোগ, মনোনয়নের পর থেকে প্রতি রাতেই ঝাড়খণ্ড লাগোয়া চরিচা, টাঙশুলি, শিউলিপাহাড়ি, রাসপুরের মতো জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় গভীর রাতে দরজায় টোকা মেরেছে পুলিশ। গ্রামছাড়া হয়েছেন বহু জনজাতি যুবক। তার পরেও টাঙশুলি জিততে পারেনি শাসক। কোনও এক মণ্ডলের 'তাণ্ডবের' মাশুল দিয়ে মহম্মদবাজারের  রামপুর পঞ্চায়েত থেকেও হেরে ফিরতে হয়েছে শাসক দলকে। 

বলরামপুরের ঘাটবেড়ার জন্মেজয় সিংয়ের কাছে শুনেছিলাম, ''অন্য দল করতে শুরু করায় ওরা চাল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।'' কৃষ্ণ হেমব্রম বলছিলেন, ''জবাব দিলেই কপাট ধাকালছে। আমরা নাই মানবেক। পুলিশ পাঠাইলেও নাই মানবেক।''

জঙ্গলমহলের পথে পথে এ বার একটি দেওয়াল লিখনই সর্বত্র চোখে পড়বে যে কোনও সচেতন পথিকের। সেই স্লোগান হল, ''পুঁতেছিলাম ঘাস, হয়ে গেছে বাঁশ।'' তবে কি শাসক দলের নেতা, প্রতি-নেতা, হাফ-নেতা, পুলিশ-সিভিক— জঙ্গলমহলে সবাই এখন 'বাঁশের' প্রতীক?