৪৭,৪৫১ বুথ মহিলা ভোটকর্মী নেই একজনও


যুদ্ধবিমান ওড়াচ্ছেন বায়ুসেনার তিন তরুণী৷ চিন্তাভাবনা বদলে মেয়েদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেনাবাহিনী৷ এ ছবি যদি প্রগতির হয়, সঙ্গী এর উল্টো ছবিও৷ কাল, সোমবার রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন৷ ভোট হবে ৪৭,৪৫১টি বুথে৷ অর্থাৎ, বুথে থাকবেন সবমিলিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটকর্মী৷ কিন্তু থাকবেন না একজন মহিলাও৷ সংখ্যাটা স্রেফ শূন্য৷ 

শনিবার থেকেই ব্যালট বাক্স নিয়ে বুথে যেতে শুরু করেছেন ভোটকর্মীরা৷ সবটাই পুরুষ-সর্বস্ব৷ যা নিয়ে ফিসফাস চলছে অফিসে-দপ্তরে৷ পুরুষ কর্মীদের একাংশ প্রশ্ন তুলছেন, মহিলাদের এই ছাড় কেন? এ ভাবে চললে সমতা আসবে কী ভাবে? প্রমীলামহলের পাল্টা প্রশ্ন, মহিলাদের পুরোপুরি বাদ রাখার কারণ কী? মহিলারা পারবেন না, এমন মানসিকতা পুরুষতান্ত্রিকতারই প্রতিফলন নয় কি? 

দিল্লির মুখ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্য প্রশাসন জানাচ্ছে, বুথে মহিলাদের পাঠানোর চল দেশে প্রায় নেই৷ অধিকাংশ বুথে পাঠানো হয় পুরুষদেরই৷ মহিলাদের সংখ্যা হয় হাতে-গোনা৷ ইদানীং ভোটে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে মহিলা পরিচালিত বুথের বন্দোবস্ত করছে প্রশাসন৷ সেটাও হয় মূলত শহর এলাকায়৷ যেমন, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ১,১৪৭টি মহিলা পরিচালিত বুথ বানানো হয়েছিল৷ মোট বুথের সংখ্যা ছিল ৭৭,২৪৭৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মহিলা বুথের সংখ্যা ছিল চারশোর কিছু বেশি৷ কিন্তু এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আলাদা করে কোনও মহিলা বুথ নেই৷ তাই পদাধিকার বা সরকারি দপ্তরে কাজ করার সূত্রে হাতে-গোনা কয়েকজন মহিলা রিটার্নিং অফিসার, মাস্টার ট্রেনার হয়েছেন বা দায়িত্ব পেয়েছেন ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার, রিসিভিং সেন্টারে৷ কিন্তু বুথে মহিলা ভোটকর্মী নৈব নৈব চ৷ 

কেন? কমিশন-প্রশাসনের অন্দর থেকে উঠে আসছে দু'টি যুক্তি৷ এক, যেখানে ভোট হয়, তার এক বা দু'দিন আগেই ভোটকর্মীদের পৌঁছে যেতে হয়৷ সেখানে মহিলাদের জন্য আলাদা করে বন্দোবস্ত করা মুশকিল৷ দুই, গন্ডগোলের মধ্যে পড়লে শ্লীলতাহানি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা৷ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব নীলাঞ্জন শান্ডিল্যের মন্তব্য, 'আমরা ভোট করতে রাজ্য সরকারের কাছে লোক চাই৷ পৃথক ভাবে কোনও নির্দেশ দিই না৷ আসলে পঞ্চায়েত গ্রামের ভোট৷ গ্রামে, মফস্সলে মহিলাদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়৷ তাই প্রশাসন পুরুষদেরই পাঠায়৷' একসময় মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাজ করা রাজ্যের বর্তমান আমলা দেবাশিস সেনও সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন৷ তাঁর কথায়, 'এক-একটি বুথে পুরুষ, মহিলা মিলিয়ে মিশিয়ে দল পাঠানো মুশকিল৷ তা ছাড়া, ডিউটি ঠিক করা হয় নির্দিষ্ট মডেল ব্যবহার করে৷ কর্মীরা একেবারে শেষ মুহূর্তে জানতে পারেন, কোথায় দায়িত্ব পড়ছে৷ মহিলাদের একেবারে শেষবেলায় জানানো সম্ভব হয় না৷' 

প্রশাসনের এই যুক্তি কতটা মানছে নাগরিক সমাজ? নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেন, 'এটা এক ধরনের আগলে রাখার মনোভাব৷ আসলে ৬৮ বছরের গণতন্ত্রে মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করা হয়নি৷ তাই এমন হচ্ছে৷ আমি নিজেও সমতা চাই৷ কিন্তু এমন ধরনের ক্ষেত্রে বাস্তবে কতটা পারব, জানি না৷' একবার পঞ্চায়েতের উপনির্বাচনে বুথে কাজ সামলেছেন বালুরঘাটের নারী ও শিশুকল্যাণ দন্তরের আধিকারিক সবিতা রায়৷ তিনি অবশ্য বলেন, 'যে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা করতেই হবে৷ বুথে বাড়ির পরিবেশ পাব না, এটা তো জানি৷ সবটাই মানসিকতার ব্যাপার৷' সল্টলেকের বাসিন্দা, কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক রেশমা রায়চৌধুরীর মতামত, 'মেয়েদের পাঠানো হচ্ছে না, এর জন্য একশ্রেণির মেয়েই দায়ী৷ আমাদের ছেড়ে দাও, আমাদের ছেড়ে দাও, সবসময় পিঠ বাঁচানো মেয়েদের একটা স্বভাব৷ অশান্তির কথা মাথায় রেখে যে মেয়েদের বাদ রাখা হচ্ছে, সেটা প্রশাসনের উদারতা৷ না পারার কী আছে, এই প্রশ্নও তোলা দরকার৷'