কোটিপতি নেতাদের মাইনে বাড়ে, খেতমজুরদের নয়...


ভারতে সব চাইতে বড়লোক কে? কে আবার, খেতমজুর। যার আর টাকার প্রয়োজন নেই, সে-ই তো ধনী। নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মতে, এ দেশে সে লোকটি হলেন খেতমজুর। তাই দেশের দশ-দশটা রাজ্যে এ বছর একশো দিনের কাজের মজুরি বাড়েনি এক টাকাও। আরও পাঁচখানা রাজ্যে মজুরি বেড়েছে দিনে দু'টাকা।

তাই বলে কি কেন্দ্রকে কঞ্জুস বলা উচিত? ছি! এই তো এ বছর সাংসদদের মাইনে পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা করা হল। হতে পারে, ৫৪১ জন সাংসদের মধ্যে ৪৪২ জনই কোটিপতি। তাতে সরকারের কী? বাজারদরের হিসেব কষে মাইনে ডবল হয়েছে।

আর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী? সে বেচারির মাইনে বাড়াতে হয়েছে আড়াইগুণ। সপ্তম বেতন কমিশন চালু হয়েছে এ বছর। যাঁর 'বেসিক' ছিল সাত হাজার টাকা, এখন হল আঠারো হাজার টাকা। যিনি পেতেন নব্বই হাজার, এখন পাচ্ছেন আড়াই লক্ষ টাকা। সংসার চালাতে হবে তো?

মজুর সংগঠনগুলো শোরগোল তুলেছে, ওই বাজারদর ধরে হিসেব করলে অন্তত ছ'শো টাকা দাঁড়ায় খেতমজুরের মজুরি। সেটা দিলে না কেন? কী মুশকিল! দেশটা এক হতে পারে, তা বলে হিসেব সবার জন্য এক হবে নাকি? খেতমজুরের জন্য কেন্দ্র তৈরি করেছে বাজারদরের আলাদা সূচক (কনজ়িউমার প্রাইস ইন্ডেক্স-এগ্রিকালচারাল লেবার)। মজুরদের খেয়েদেয়ে গায়ে জোর করতে হয়, তাই সেই হিসেবে সব চাইতে গুরুত্ব (সত্তর শতাংশ) পায় খাদ্য। তার পর বস্ত্র। খাতা-পেনসিল, ওষুধ-বাসভাড়া সূচকে প্রায় এলেবেলে। এই সূচক কিন্তু ইউপিএ আমলের, মোদী সরকারের তৈরি নয়।

অথচ মাত্র এক টাকা মজুরি বাড়ার ক্ষোভে উত্তরপ্রদেশের খেতমজুররা গোসা করে বাড়তি টাকাটা মোদীকেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ় সাংবাদিকদের বলেছেন, এক টাকা বাড়ানো মজুরি বৃদ্ধি নয়, মজুরের অপমান। ঝাড়খণ্ডের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব মোদীকে চিঠি লিখেছেন, গত দশ বছরে দেশে প্রকৃত মজুরি কুড়ি শতাংশ বেড়েছে, কেন্দ্র একশো দিনের কাজের মজুরি পাঁচ শতাংশও বাড়ায়নি। কেন কাজ করবে লোকে?

রাজ্য সরকারগুলোও হিংসুটে। নিজেদের সূচক ধরে (কনজ়িউমার প্রাইস ইনডেক্স-রুরাল লেবার) গ্রামে ন্যূনতম মজুরির হিসেব করে। তাতে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, পরিবহণ-বিনোদন, হাবিজাবি সব ঢুকিয়ে রেখেছে। ফলে মজুরির অঙ্ক বেড়েই চলেছে। মোদীর সাকিন গুজরাত রাজ্যের মজুরি (২৯৮ টাকা) কেন্দ্রের মজুরির চেয়ে ১০৪ টাকা বেশি। পশ্চিমবঙ্গের ন্যূনতম মজুরি (২৩৪ টাকা) একশো দিনের কাজের মজুরির (১৯১ টাকা) চেয়ে ৪৩ টাকা বেশি। এত বাড়াবাড়ি কেন রাজ্যগুলোর? কেন আবার, ট্যাঁক থেকে টাকা দেয় না বলে। খেতমজুরকে কত দিতে হবে, নোটিস দিয়েই খালাস। দিতে তো হয় কেন্দ্রকে। গত বছর কেবল পশ্চিমবঙ্গে একশো দিনের কাজের মজুরি বাবদ কেন্দ্র দিয়েছে ছ'হাজার কোটি টাকা। ন্যূনতম মজুরি দিতে হলে লাগত আরও দেড় হাজার কোটি। ইয়ার্কি নাকি?
ন্যূনতম মজুরি জিনিসটা প্রায় ইয়ার্কিই ছিল অনেক দিন পর্যন্ত। 'শ্রমিককে ন্যূনতম মজুরি দেওয়া চাই' কথাটা ছিল 'ভারত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' বলার মতো। আইডিয়া হিসেবে ভাল, কাজের বেলা কিছু না। গরিব যা পাবে, তাতেই খাটবে, সেই ছিল দস্তুর। ধারণাটা ধাক্কা খেল যখন প্রথম ইউপিএ সরকার ২০০৫ সালে গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প়ের টাকা রাজ্যের ন্যূনতম মজুরির হারে দিতে শুরু করল। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম খেতমজুর জমির মালিকের সঙ্গে দরাদরির ক্ষমতা অর্জন করল। দীর্ঘ দিন মাটিতে মুখ ঘষে ঘষে চলার পরে মাথা তুলল গ্রামীণ মজুরির হার, ছ'সাত বছর ক্রমাগত বাড়তে থাকল।

তার মধ্যেই শুরু হল রাশ টানা। ২০০৯ সালে রাজ্যের সূচকের থেকে ইউপিএ সরকার কেন্দ্রের সূচককে আলাদা করে দিল, আর সূচকের ভিত্তি করল ২০০৯-এর বাজারদরকে। তার ফল কী হচ্ছে, বুঝতে একটু সময় লাগল। ২০১১ সালেও মাত্র চারটে রাজ্যে কেন্দ্রের মজুরি রাজ্যের চাইতে কম ছিল। আজ আঠাশটা রাজ্যে কেন্দ্রের মজুরি রাজ্যের ন্যূনতম মজুরির চাইতে কম।

মজুরদের সংগঠনগুলো শোরগোল তুলেছে, কেন্দ্র আইন ভাঙছে, আদালতের অবমাননা করছে। সুপ্রিম কোর্ট-সহ নানা আদালত বার বার রায় দিয়েছে, ন্যূনতম মজুরির কম দিলে তা 'ফোর্সড লেবার', দাস-শ্রম। অগত্যা কেন্দ্র কমিশন বসিয়েছে। ইউপিএ আমলের দুটো কমিশনের রিপোর্ট সুবিধের হয়নি। মহেন্দ্র দেব কমিটি তো গত বছর বলল, রাজ্যের হারেই মজুরি দিতে হবে। আর ২০০৯ সালের বাজারদর ধরে মজুরি গুনলে হবে না, ভিত্তিবর্ষ ধরতে হবে ২০১৪। উপাচার্য না হলে এমন বেআক্কেলে হয়!

মোদী সরকার সে রিপোর্ট বাতিল করে, পাঁচ জন আমলা দিয়ে কমিটি গড়ল। ব্যস, রিপোর্ট এল মনের মতো। নয়া কমিটি বলেছে, রাজ্যের হারে মজুরি দেওয়ার দরকার নেই। ২০০৯ সালকে 'ভিত্তিবর্ষ' রাখলেও ক্ষতি নেই। তবে হ্যাঁ, কেন্দ্রের সূচকটা বাদ দিয়ে রাজ্যের সূচকটাই ধরা হোক। জনান্তিকে আমলারা জানাচ্ছেন, ২০০৯-এর বাজারদর ধরে হিসেব করলে ওই এক-দু'টাকার বেশি মজুরি বাড়বে না, সে যে সূচকই ধরো না কেন।

না বাড়লেই বা! গাঁইতি-কোদাল দিয়ে একটু মাটি খুঁড়বে, চাট্টি গাছ পুঁতবে, তার জন্য কোটি কোটি টাকা দেবে কেন্দ্র