বাবার দোকান চালিয়ে রাজ্যে নবম সুরজিৎ


দরমার বেড়া আর টালির চালের ছোট্ট একটি ঘর। সাইনবোর্ড লিখে কোনও রকমে সংসার চালাতেন বাবা। ডিজিটাল যুগে হাতে লেখা সাইনবোর্ডের কদর কমেছে। তাই পেশা বদলে বাড়ি লাগোয়া একটি গুমটিতে মুদি দোকান চালান। সামান্য আয়ে ছেলের পড়াশোনায় সে ভাবে নজর দিতে পারেননি। উল্টে পড়াশোনার ফাঁকে বাবার সঙ্গে দোকান চালিয়েছে ছেলে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে রাজ্যের মেধা তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে কালনার উত্তর গোয়াড়ার সুরজিৎ মাতব্বর৷ ৪৮২ নম্বর পেয়ে রাজ্যে নবম হয়েছে সে। আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যেও সাফল্যের চূড়ায় যে পৌঁছনো সম্ভব তা প্রমাণ করল কালনা অম্বিকা মহিষমর্দিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ছাত্র। আপাতত ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হয়ে ভবিষ্যতে ডব্লিউবিসিএস অফিসার হতে চায় সুরজিৎ।

শুক্রবার ফল ঘোষণার পরই সুরজিতকে শুভেচ্ছা জানাতে বাড়িতে ভিড় করেন প্রতিবেশীরা। সুরজিতরা দুই ভাই। দাদা বিক্রম কালনা কলেজে বিএ অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র৷ পড়াশোনায় বরাবরই ভালো সুরজিৎ। মাধ্যমিকে ৬৪৯ পেয়েছিল সে। ছেলেকে পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও সামান্য আয়ে সংসার চালিয়ে বিষয় ভিত্তিক প্রাইভেট টিউশন দিতে পারেননি বাবা ঝন্টু মাতব্বর। এক জন প্রাইভেট শিক্ষক ছিলেন। তাঁকেও প্রতি মাসে ঠিকমতো বেতন দিতে পারেননি। স্কুলের শিক্ষকদের পাশাপাশি তাপস বাজপেয়ী নামে ওই প্রাইভেট শিক্ষকের সাহায্যে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে সুরজিত। তাতেই মিলেছে সাফল্য। বিষয় ভিত্তিক তার প্রাপ্য নম্বর বাংলায় ৯৫, ইংরেজিতে ৯৩, ভূগোলে ৯৯, কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনে ৯৭, এডুকেশনে ৯৬ ও দর্শনে ৯৫৷ 

সুরজিতের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, দরমার ঘরটিও ভগ্ন অবস্থায়। তেলের টিন কেটে লাগানো হয়েছে ক্ষয়ে গিয়ে ফাঁক হওয়া দরমার মাঝে। ঘরের সামনে একফালি বারান্দা৷ মা বিউটি মাতব্বর বলেন, 'আমাদের একটিই ঘর। ফলে ঘরে আমরা থাকলে ছেলেদের পড়ার অসুবিধা হত। তাই আমি এবং ওর বাবা বাইরে বারান্দায় থাকি। অভাবের মধ্যে ছেলেদের পড়াশোনায় সে ভাবে কিছুই করতে পারিনি। তার মধ্যে ছেলে এমন ফল করায় খুব ভালো লাগছে। তবে এর পর কী ভাবে ওকে পড়াব জানি না।' ঝন্টু মাতব্বর সাইনবোর্ড লেখার কাজ করতেন৷ কিন্তু হাতে লেখা সাইনবোর্ডের চাহিদা না থাকায় বাড়ি লাগোয়া গুমটিতে মুদিখানার দোকান চালু করেন। মাঝে মধ্যেই দোকানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করত সুরজিৎ৷ ঝন্টু বলেন, 'আগে শুধু সাইনবোর্ড লেখার কাজই করতাম৷ কিন্তু এখন হাতে লেখা সাইনবোর্ডের চাহিদা কমেছে৷ তাই গুমটিতে দোকান চালাই৷ মাঝে মধ্যে সাইনবোর্ড লেখারও বরাত মেলে৷ তবে সামান্য আয়ে সংসারই চলে না। দুই ছেলেরই পড়াশোনায় আগ্রহ আছে। কিন্তু ওদের জন্য তেমন খরচ করতে পারি না৷ ভালো রেজাল্ট করায় চিন্তা বেড়ে গেল। উচ্চ শিক্ষার টাকা কী ভাবে জোগাড় হবে জানি না।' 

পড়াশোনার সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল দুটোই প্রিয় সুরজিতের৷ বিশ্বকাপে তার পছন্দের দল ব্রাজিল৷ পড়াশোনা এবং বাবার সঙ্গে দোকানে কাজ করার পাশাপাশি খেলার খবরেও নজর রয়েছে তার। সুরজিতের কথায়, 'শিক্ষকরা আমাকে সব সময় সাহায্য করেছেন। যে ভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম তাতে ভালো ফলের আশা করেছিলাম। কিন্তু মেধা তালিকায় আমার নাম থাকবে ভাবতে পারিনি।' সুরজিতের এমন সাফল্যে খুশি স্কুলের শিক্ষকরাও। প্রধান শিক্ষক বিশালাক্ষ সেন বলেন, 'আমাদের স্কুলের নাম উজ্জ্বল করেছে সুরজিৎ। ও অনেক বড় জায়গায় পৌঁছে যাক এটাই চাইব।'