কোটিপতিদের দান-খয়রাত করে গরীবদের আত্মহত্যার পিছনে ভারতীয় ব্যাংক


কলকাতা: গত আর্থিক বছরে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার কোটি টাকা অনুৎপাদক সম্পদ ভারতের ব্যাংকগুলির৷ যে ঋণ আর কোনদিনই উদ্ধার করা যাবে না৷ অনাদায়ী ঋণকে ব্যাংকের হিসাবের খাতা থেকে মুছে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায়ই নেই৷ ঋণের বেশির ভাগটাই কর্পোরেট সেক্টরে বড় বড় ব্যবসায়ীদের নেওয়া। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে ৬৩৫১ জন কৃষক ও ৫০১৯ জন কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক আত্মহত্যা করেছে এই ব্যাংক ঋণ শোধ না করতে পেরেই৷ ব্যাংকগুলির দ্বিমুখী নীতি সাধারণ মানুষের চোখের সামনে প্রকাশ্য। আর এর পিছনে রয়েছে সেই 'নোংরা' রাজনীতির খেল।

ICRA-র সাম্প্রতিক রিপোর্টে এসেছে এক ভয়ানক তথ্য৷ রিপোর্টে বলা হয়েছে, শেষ ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলি ৪,০০,৫৮৪ কোটি টাকা বা ৪ লক্ষ ৫৮৪ কোটি টাকা ঋণ আদায় করতে পারে নি৷ শেষ ১০ বছরে, প্রাইভেট ব্যাংকগুলি আদায় করতে পারে নি ৭৯,৪৯০ কোটি টাকার ঋণ৷ ICRA এর হিসাব মত মোট ৪,৮০,০৯৩ কোটি ঋণের টাকা বাজার থেকে ফেরত পায় নি ব্যাংকগুলি৷

বছরের পর বছর দেখেও শিক্ষা নেয়নি ভারতের ব্যাংকগুলি, তার প্রমাণ গত আর্থিক বছরের হিসাবেই৷ গত বছরেও সব ব্যাংকগুলির ১,৪৪,০০০ কোটি টাকার অদেয় ঋণ রয়েছে৷ এই টাকাটা আর উদ্ধার করতে পারবে না ব্যাংকগুলি৷ পুরো টাকাটাই ক্ষতি ধরে নিয়ে হিসাবের খাতা থেকে তা মুছে দিয়েছে সবাই৷ এই ঋণের সিংহ ভাগের জন্যই দায়ী হল কর্পোরেট সেক্টর৷

এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত এই ঋণ উদ্ধার করতে পারেনি ব্যাংকগুলি৷ গত আর্থিক বছরের চেয়ে যা প্রায় ৬১.৮ শতাংশ বেশি৷ গত আর্থিক বছরে এই অনাদায়ী ঋণের পরিমাণটা ছিল ৮৯,০৪৮ কোটি টাকা৷ বিজয় মালিয়া, নীরব মোদী কান্ড থেকে তাহলে কি কিছুই শিক্ষা নিচ্ছে না ভারতের ব্যাংকগুলি? প্রশ্ন কিন্তু উঠছে৷

অন্যদিকে কর্পোরেট সেক্টরের প্রতি নরম মনোভাব নিলেও গরীব মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায়ে কঠোর থাকে ব্যাংক৷ এরই জেরে ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন একের পর এক কৃষক। ২০১৬ সালের রিপোর্টে যা ২০১৫ সালের ভারতের তথ্য উঠে এসেছে, দেখা যাচ্ছে ৮০০৭ জন কৃষক ও ৪৫৯৫ জন কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০১৪ সালে ৫৬৫০ কৃষক ও ৬৭১০ জন কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০১৬ ও ২০১৭ সালে কতজন কৃষক আত্মহত্যা করেছে তার রিপোর্ট এখনও বের করতে পারে নি মোদী সরকার।

ন্যাশান্যাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৬ সালের রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৫ তে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ১৯.৫ শতাংশ কৃষক৷ এর মধ্যে আবার ব্যাংকে ধার শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন তার প্রায় ৩৮.৭ শতাংশ৷ গত কয়েক মাসেই বেশ কয়েকজন কৃষকের আত্মহত্যা সংবাদের শিরোনামে আসে৷ তখনই দেখা যায়, এই নিয়ে ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোন রেকর্ডই বের করে নি মোদী সরকার৷

চলতি বছরের মে মাসেই পরপর ৬ জন কৃষকের আত্মহত্যার খবর আসে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ থেকে৷ কারণ সেই একই৷ কৃষি ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন ওই কৃষকরা৷ কৃষিজাত পণ্যের দাম কমে যাওয়াতেই ঠিকমত ফসলের দাম পান নি ওই কৃষক ও কৃষিকাজে যুক্ত শ্রমিকরা৷ ফলে কৃষিঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। কারণ ব্যাংকের কৃষি ঋণ শোধ করার একটা প্রচন্ড চাপ ছিল কৃষকদের উপর৷

একদিকে, কোটিপতি ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে শোধ করছেন না। অন্যদিকে, কৃষিকাজের জন্য সামান্য ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন হাজার হাজার কৃষক ও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। শুধু তাই নয়, নিম্ন অথবা মধ্যবিত্ত মানুষ ঋণ নিলে কোনও কারণে পরিশোধে সমস্যা হলে ব্যাংক তা আদায় করতে যতটা তৎপর হয় তার থেকে বহুগুণ টাকা ঋণ নেওয়া এক একজন শিল্পপতিদের কাছ থেকে তা আদায় করার ব্যাপারে সেই তৎপরটা থাকে না৷ বরং ঋণ না মেটাতে পারা শিল্পপতিকে উল্টে আরও কিছু ঋণ দিতেও দ্বিধা করা হয় না৷ এরজন্য অজুহাত দেখান হয় যদি আরও কিছুটা ঋণ দিয়ে ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসাটা বাঁচান যায় তাহলে দেশ তথা সামগ্রিক অর্থনীতির পক্ষে মঙ্গল৷

ক্ষতিগ্রস্ত কিংফিশারের পতন আরম্ভ হয়ে যাওয়ার পরেও ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল৷ অথচ ঋণ কি আদৌ সংস্থা বাঁচাতে কাজে লেগেছিল নাকি বিজয় মালিয়ার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য ব্যয় হয়েছে সেই প্রশ্ন অনেকবার উঠেছে৷ একের পর এক কৃষক ঋণের টাকা মেটাতে না পেরে আত্মহত্যা করছে কিন্তু কোনও শিল্পপতিকে ঋণের টাকা মেটাতে না পেরে আত্মহত্যা করতে সচরাচর দেখা যায় না৷

এটা ঠিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মানে ভোট ব্যাংকের কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে অনেক সময় কৃষি ঋণ মকুব করা হয়৷ যে কোনও ঋণ মকুবই ব্যাংকের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর৷ কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কৃষকদের ঋণ মকুব যখন যে দল করে, তার ফলাও করে প্রচার করে৷ অথচ তার চেয়ে অনেক অনেক বড় অংকের টাকা শিল্পপতিদের জন্য মকুব করা হলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তা চেপে যেতে দেখা যায়৷

জানতে পারা যায় বলেই কৃষি ঋণ মকুবের পরে অনেক নাগরিকই চায়ের আড্ডা থেকে ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার হন এর বিরুদ্ধে৷ তাদের দেওয়া করের টাকায় এই ঋণ মকুব হল বলে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়৷ কিন্তু প্রচারের অভাবে শিল্প ঋণ অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হলেও তা তেমন জানতে পারা যায় না৷ ফলে তেমন আলোচনাতেও আসে না৷ অবশ্য এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলা চলে বিজয় মালিয়া বা নীরব মোদীর ঘটনা৷ তাদের নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিতে দেখা গিয়েছে অনেককেই৷ তবে, সেটাও খবরে আসার পরেই।

মাত্র কয়েক হাজার টাকা ঋণ শোধ করতে না পারায় ব্যাংক কর্তাদের জ্বালায় একের পর এক ঋণগ্রহণকারী কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন শেষ ১০ বছর ধরে। আর সেই ব্যাংকেরই লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বেমালুম শোধ না দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে কোটিপতি ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক সেই ঋণ গুলি অনাদায়ী ঘোষণা করে হিসাবের খাতা থেকেই মুছে দিচ্ছে দিনের পর দিন। এই চরম অবিচারের নামই ভারতবর্ষ।