প্লাস্টিকখেকো জীবাণুর খোঁজ পেলেন বাঙালি বিজ্ঞানী, দূষণ নিয়ন্ত্রণে নয়া দিশা


পাইপ থেকে বোতল, ক্যারিব্যাগ থেকে খেলনা। প্লাস্টিকের তৈরি জিনিস খেয়ে ফেলছে জীবাণু। মিশিয়ে দিচ্ছে মাটিতে। ধাপা থেকে এমন ১৮টি প্লাস্টিকখেকো জীবাণু আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন এক বাঙালি অধ্যাপক-বিজ্ঞানী। তাঁর দাবি, প্লাস্টিকের মতো লয়-ক্ষয়হীন বস্তুকে পঞ্চভূতে বিলীন করে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনে বিপ্লব আনবে এই আবিষ্কার।

আবিষ্কৃত জীবাণুর নাম জানতে দেশ-বিদেশ থেকে বহু বর্জ্য ব্যবস্থাপন সংস্থা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ একটি ফরাসি সংস্থা অধ্যাপকের ল্যাবরেটরিতে এসে কয়েক কোটি ডলারের 'অফার'-ও দেয়। ড. স্বপন ঘোষ। রহড়ার রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ সেন্টেনারি কলেজের মলিকুলার মাইকোপ্যাথলজি ল্যাবরেটরির এই অধ্যাপক দীর্ঘদিন ধরে ব্যাকটেরিয়া-জীবাণু নিয়ে কাজ করছেন। সহযোগী হিসাবে পান দুই ছাত্র সুজয় পাল ও সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়। 'অধ্যাপক সিউডোমোনাস' ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তীর ছাত্র হওয়ার সুবাদে তেলখেকো 'সিউডোমোনাস পুটিডা'-র সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় স্বপনবাবুর। ২০১৩ সালে কল্যাণীর গয়েশপুরের কয়েকটি চাষের জমি থেকে মাটি পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন স্বপনবাবুরা। সেই নমুনায় কিছু প্লাস্টিক মিশে ছিল। সেখানেই ধরা দেয় কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক। যারা নিজেদের শরীর থেকে এমন এক উৎসচেক বের করছে যা প্লাস্টিকের হাইড্রোকার্বন পলিমার শৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলছে।

স্বপনবাবু জানালেন, সিউডোমোনাস অ্যারোজিনোসা নামে ওই প্লাস্টিকখেকো ব্যাকটেরিয়ার উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, প্লাস্টিকের ওজন তিন মাসে অর্ধেক করতে সক্ষম এই ব্যাকটেরিয়া। পেনিসিলিয়াম সিম্পলিসিজিমাম নামে একটি প্লাস্টিকখেকো ছত্রাকেরও হদিশ দিয়েছেন স্বপনবাবু। গয়েশপুরের পাশাপাশি ধাপা থেকেও সংগৃহীত প্লাস্টিকেও ১৮ রকমের প্লাস্টিকখেকো জীবাণুর হদিশ পেয়েছেন স্বপনবাবুরা। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাকটেরিয়া তিনমাসে প্লাস্টিকের ওজন ৬০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। যদিও গবেষণার স্বার্থে সেই ব্যাকটেরিয়াগুলির নাম এখনই প্রকাশ্যে আনছেন না স্বপনবাবুরা। জানালেন, ওই ব্যাকটেরিয়াগুলির উপর পেটেন্টের আবেদন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রককেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। পেটেন্ট পেলেই নামগুলি প্রকাশ্যে আনা হবে। স্বপনবাবুর ইচ্ছা, কেন্দ্র সাড়া দিলে তিনি খড়দহ পুরসভার সঙ্গে যৌথভাবে প্লাস্টিক নিধন যজ্ঞ শুরু করতে চান। প্লাস্টিক ভর্তি খোলা ভ্যাটে জীবাণু ছেড়ে ভেল্কি দেখাতে চান। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্র অবশ্য জানিয়েছেন, "এমনটা হলে তো ভালই। কিন্তু স্বপনবাবুদের গবেষণাপত্র না দেখা পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করতে পারব না।"

সভ্যতার বিকাশে প্লাস্টিকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চায়ের কাপ থেকে বিমান সবেতেই প্লাস্টিক। ফি বছর প্রায় ১৪০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয় বিশ্বে। এর একটা বড় অংশ নদী-নালায় দূষণ ছড়ায়। নিকাশি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। পানীয় জল ও খাদ্যে প্লাস্টিকের বিষ মিশে প্রাণীদেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। ফলে, প্লাস্টিক নিয়ে এক গভীর সংকটের মুখে সভ্যতা। এই সংকট থেকে মুক্তির পথ দুটো। এক, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে। দুই, সিউডোমোনাস অ্যারিজিনোসার মতো ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিক পচাতে ব্যবহার করতে হবে। ২০১৬-তে জাপানের 'কিয়োটা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'-র অধ্যাপক জসিডা এমনই এক প্লাস্টিকখেকো জীবাণু আবিষ্কার করেছিলেন। স্বপনবাবুর আবিষ্কার তার ৩ বছর আগের। সেই হিসাবে বলা যায়, প্লাস্টিক পচাতে বাংলাই পথ দেখাবে গোটা বিশ্বকে। এমনটাই মনে করছেন বিশিষ্ট পরিবেষবিদ সুভাষ দত্ত। তিনি জানালেন, এই জীবাণুগুলি প্লাস্টিকের অভিশাপ থেকে যদি মুক্তি দেয়, তাহলে তো কথাই নেই। কেন্দ্র ও রাজ্য দু'পক্ষেরই উচিত স্বপনবাবুদের উৎসাহ দেওয়া।