মুখই বলে দিচ্ছিল, চাপে মেসি


আর্জেন্টিনা ১ • আইসল্যান্ড ১
 

লিয়োনেল মেসির পেনাল্টি মারতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল।

এ রকম চাপের মুখে আর্জেন্টিনা অধিনায়ক কেন ঝুঁকিটা নিলেন, সেটা বুঝতে পারলাম না। আইসল্যান্ডের গোলকিপার হ্যালদরসন যে দিকে ঝাঁপালেন, সে দিকেই কিকটা মেরে দিলেন মেসি। পেনাল্টি মারার নিয়ম হল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিপক্ষ গোলকিপারের নড়াচড়ার দিকে নজর রাখতে হয়। শেষ মুহূর্তে ঠিক করতে হয় কোন দিকে বল মারতে হবে। তবেই সফল হওয়া যায়। মেসি তো সেই রাস্তায় হাঁটলেনই না।

এমনিতে ক্লাব বা দেশের হয়ে পেনাল্টি মারার ব্যাপারে মেসির সাফল্য কম। শেষ সাতটা পেনাল্টির চারটেতেই ব্যর্থ। ১-১ অবস্থায় চাপের মুখে ফের ভুল করে ফেললেন তিনি। হাভিয়ের মাসচেরানো বা অ্যাঙ্খেল দি'মারিয়া তো ভাল কিক নেন। ওঁদের কাউকে পাঠানো উচিত ছিল।


ক্লাব ফুটবলে আকাশছোঁয়া সাফল্য সত্ত্বেও দেশের হয়ে মেসির সাফল্য নেই— চার দিক থেকে ওঠা এই আওয়াজ সম্ভবত প্রচণ্ড চাপে ফেলে দিয়েছে মেসিকে। শুরু থেকেই ওঁর মুখটা দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল।

একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। টিভিতে শুক্রবার রাতে পর্তুগাল-স্পেন খেলাটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো পেনাল্টি মারার আগে তাঁর সংকল্পে অটল মুখটা মনে করুন। পাশাপাশি, শনিবার সন্ধ্যায় আর্জেন্টিনা বনাম আইসল্যান্ড ম্যাচে পেনাল্টি মারতে যাওয়ার সময়ে মেসির মুখটা দেখুন। তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। অতি চিন্তার, ভয়ার্ত একটা মুখাবয়ব নিয়ে কিকটা মারতে গেলেন মেসি। এমনিতেই তিনি শান্ত স্বভাবের। নরম প্রকৃতির। তার উপরে এই চাপ। মেসি নিজের খেলাটা খেলতেই পারলেন না। আইসল্যান্ড বক্সের বাইরে থেকে তাঁর বাইশ-পঁচিশ গজের পাঁচ-পাঁচটা ফ্রি-কিক সেই জন্যই কামড় বসাতে পারল না। যা একেবারেই মেসিসুলভ মনে হয়নি আমার। গ্যালারিতে বসে থাকা দিয়েগো মারাদোনাকেও দেখলাম হতাশ। পেনাল্টির পরে দু'হাতে মুখ ঢাকলেন।

মেসি জিনিয়াস। একটা ম্যাচের হিসেব বা পেনাল্টি দিয়ে তাঁকে বিচার করতে যাওয়া মূর্খামি। পরের ম্যাচেই দেখবেন, তিনি আবার 'ঈশ্বর' হয়ে গিয়েছেন। খেতাবের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন আর্জেন্টিনা সমর্থকদের। সক্রেটিস থেকে প্লাতিনি— পেনাল্টি নষ্ট করেছেন অনেক তারকাই। মেসি ব্যতিক্রম নন। কিন্তু যেটা বলতে চাইছি তা হল, গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচের এই পয়েন্ট নষ্ট করাটা চাপে ফেলে দিল সাম্পাওলির দলকে। মেসি নির্ভরতা না-কমালে, পরের ক্রোয়েশিয়া বা নাইজেরিয়া ম্যাচে কিন্তু সমস্যা
বাড়বে আজেন্টিনার।

তবে একা মেসিকে কেন দোষ দেব? তাঁকে তো তাঁর সতীর্থরা সে ভাবে সাহায্যই করতে পারলেন না এ দিন। ফলে যা হয়, আইসল্যান্ডের তিন-চার জন ফুটবলারের চক্রব্যূহে বেশির ভাগ সময়ে আটকে থাকতে হল মহাতারকাকে। সতীর্থ দি মারিয়া, মাসচেরানো, মেজা, বিগলিয়ারা তো ওঁকে বল জোগান দিতেই পারছিলেন না। প্রথমার্ধ শুরুর কিছু ক্ষণ পরে তাই সের্খিয়ো আগুয়েরার দুর্দান্ত একটা গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে গিয়েও তা ধরে রাখতে পারল না। চার মিনিটের মধ্যেই সমতায় ফিরে এল আইসল্যান্ড। হার না-মানা মনোভাবকে সঙ্গী করে পাল্টা আক্রমণে উঠে গোল করে গেলেন আইসল্যান্ডের স্ট্রাইকার ফিনবোগাসন।

আর এই যে প্রতিপক্ষের সেরা ফুটবলারকে একটা গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখার পদ্ধতি, আর্জেন্টিনার মতো ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে এত এগিয়ে থাকা দেশকে চাপে ফেলে পয়েন্ট কেড়ে নেওয়া, এর পুরো কৃতিত্ব অবশ্যই আইসল্যান্ডের কোচ হেইমির হলগ্রিমসনের। ছেলেদের আলট্রা ডিফেন্সিভ ফুটবল খেলিয়ে তিনি দেখালেন, কী ভাবে সাম্পাওলির মগজাস্ত্রকে ভোঁতা করে দেওয়া যায়। একটা সময়ে দেখলাম মেসিরা ২-৬-২ ফর্মেশনে গিয়েও কিছু করতে পারছেন না। এর কারণ দু'টো। এক) আইসল্যান্ড ফুটবলারদের সকলের উচ্চতা ছ'ফুটের উপরে। তাই ওঁরা বড় বড় স্ট্রাইড নিয়ে মেসি-মাসচেরানো, ওটামেন্ডিদের অনেক আগে পৌঁছে যাচ্ছিলেন সব পজিশনে। নিজেদের গোল বক্সে বা পাল্টা আক্রমণের সময় প্রতিপক্ষ বক্সে— সব জায়গাতেই সংখ্যায় আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছিলেন সিগুররোসনরা। দুই) 'কিছুতেই হাল ছাড়ব না' মনোভাব নিয়ে নেমেছিল আইসল্যান্ড। সাড়ে তিন লাখ লোকের দেশ প্রথম বার বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলছে। বড় দলের বিরুদ্ধে জেদ নিয়ে তো নামবেই। কলকাতা লিগে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে এ রকম মনোভাব নিয়ে নামত পোর্ট ট্রাস্ট, স্পোর্টিং ইউনিয়ন। এক পয়েন্ট পেলেই ওরা খেতাব জেতার মতো আনন্দ করত।

সেটা এখানেও দেখলাম। খেলার শেষে হতাশ মেসি যখন মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়ছেন, তখন দেখলাম, আইসল্যান্ড ফুটবলাররা উচ্ছ্বাসে ভাসতে ভাসতে গ্যালারিতে সমর্থকদের কাছে গিয়ে অভিবাদন নিচ্ছেন।

নিজে রক্ষণের ফুটবলার ছিলাম বলে আরও একটা কথা বলতেই হচ্ছে। ওটামেন্ডি, টাগলফিকো, রোখোদের নিয়ে তৈরি আর্জেন্টিনার রক্ষণ কিন্তু অত্যন্ত ধীর গতির ফুটবল খেলেছে এ দিন। আইসল্যান্ডের সমতায় ফেরার গোলটার আগে ওটামেন্ডিদের বক্সে অনেক ক্ষণ বল ঘুরল। আসলে প্রতিপক্ষের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না সাম্পাওলির দলের রক্ষণ। আর্জেন্টিনা কোচের আরও বড় ভুল ইগুয়াইনকে শুরু থেকে না-নামানো।

আর্জেন্টিনা পয়েন্ট নষ্ট করেছে বলে তাদের নিয়ে অবশ্য আশা ছাড়ছি না। সতীর্থদের কাছ থেকে ঠিক মতো বল পেলে মেসি তাঁর ক্লাব বার্সেলোনার মতোই আগুনে হবেন, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। নীল-সাদা জার্সিতে তাঁর সেই ঝলক দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।