১৪ বছর মায়ের লড়াই, শাস্তি পেল ৪ বছরের মেয়ের যৌন হেনস্থাকারী


সকলে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, শুধু তিনি ছাড়েননি। পণ ছিল, মেয়ের যৌন হেনস্থাকারীকে শাস্তি দিতেই হবে।
পদে পদে এসেছে বহু বাধা। অভিযুক্ত জামিনে মুক্ত হয়ে গিয়েছিল এক সময়ে। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। অবশেষে সেই অদম্য লড়াইয়ের ফলেই শাস্তি পেয়েছে অভিযুক্ত। মিলেছে স্বস্তি। জয়ীর হাসি এখন সেই মায়ের মুখে!

ঘটনাটি ২০০৪ সালের। অগস্ট মাস। নেতাজিনগর থানা এলাকার বাসিন্দা তন্ময় বসু ওরফে টিঙ্কু প্রতিবেশীর চার বছরের শিশুকে বাড়িতে ডেকে যৌন হেনস্থা করে। বাড়িতে ফিরে পরিবারের বড়দের পুরো ঘটনাটি জানায় ওই শিশু। পরে ওই নাবালিকার ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা যায়, সে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে। এর পরে তার মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার হয় তন্ময়। কিন্তু আড়াই মাস জেলে কাটানোর পরে জামিন পেয়ে যায় সে।  
এই খবরে প্রথমে ভেঙে পড়লেও অপরাধীর কঠোর শাস্তির জন্য লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন ওই মা। শুনানির দিনগুলিতে সংসারের সব কাজ ছেড়ে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই আদালতে পৌঁছে যেতেন তিনি।
ওই মহিলার অভিযোগ, ''২০০৬ সালে আলিপুর আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। টানা আট বছর শুনানি চলাকালীন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এমনকি, সরকারি নথি থেকে মেয়ের ডাক্তারি পরীক্ষার মূল কাগজপত্রও উধাও হয়ে যায়। তবুও হাল ছাড়িনি।'' অভিযোগকারিণীর আইনজীবী সঞ্জয়কুমার কুন্ডু বলেন, ''এ রকম লড়াকু মহিলা আগে দেখিনি।''

২০১৪-র ১৮ জুন আলিপুর আদালতের অতিরিক্ত বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত তন্ময় বসুকে দু'বছর জেল ও নাবালিকাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০,০০০ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরবর্তীকালে নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি তন্ময় কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে। ২০১৭-র ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী তাঁর রায়ে নিম্ন আদালতের রায়কেই বহাল রাখেন। হাইকোর্টের রায়কেও চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি এ বার সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে। ২০১৭-র অগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রাখে।

তাতেও কাজ হয়নি। পাড়ায় দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিল তন্ময়। গত জানুয়ারিতে নির্যাতিতার মা ফের আলিপুর আদালতে দরখাস্ত করে জানান, সাজাপ্রাপ্ত আসামির শীর্ষ আদালতের মামলা খারিজ হয়ে গিয়েছে। এর পরেই আলিপুর আদালত স্থানীয় নেতাজিনগর থানার মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে নোটিস দেয়। আলিপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তন্ময়। সে এখন আলিপুর জেলে বন্দি।
ওই মায়ের অভিযোগ, ''এক সময়ে মোটা টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল আসামিপক্ষ। বিকিয়ে যাইনি।'' স্বামী, মেয়েকে নিয়েই সংসার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এই মহিলার। স্বামীর মুদির দোকানই আয়ের একমাত্র উৎস।

নির্যাতিতা সেই মেয়েটি এখন দক্ষিণ কলকাতার এক কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তাঁর কথায়, ''আদালতে যাওয়ার থাকলে মা ভোরে উঠে রান্না করতেন। টানা চোদ্দো বছর এ ভাবেই চলেছে। আমাকে কখনও কোনও অসুবিধা বুঝতেই দেননি মা। এ রকম মা পেয়ে খুব গর্ব হয় আমার।'' তবে সেই মা মনে রাখেন, এই জয়ের পিছনে তাঁর স্বামী, কন্যা ও এক প্রতিবেশীর কতটা সহযোগিতা রয়েছে। তাঁর কথায়, ''আমার স্বামী বারবার বলতেন, এই লড়াই আমাদের সকলের। আমার স্বামী ও মেয়ে সর্বক্ষণ ভরসা জুগিয়েছে।'' ২০০৪ সালে মেয়ের যৌনাঙ্গ থেকে রক্তপাত বেরোতে দেখে প্রতিবেশী এক মহিলার কাছেই গিয়েছিলেন এই মা। সেই থেকে লড়াইয়ের শরিক হয়ে থেকেছেন তিনি। আলিপুর আদালতে সাক্ষী হিসেবেও গিয়েছেন।
নির্যাতিতার মায়ের অভিযোগ, ''সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অগ্রাহ্য করে টানা সাত মাস কী ভাবে সাজাপ্রাপ্ত আসামি রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারে, তা ভাবতেই অবাক লাগে।'' এ প্রসঙ্গে আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ''বিচারপদ্ধতি বিলম্বিত হলে বিচার ব্যবস্থার উপরে মানুষের আস্থা কমবেই। সব পক্ষের উচিত, মামলার শুনানি দ্রুততার সঙ্গে করে বিচারপ্রার্থীর আইনগত অবস্থান পরিষ্কার করা। তা হলে বিচার ব্যবস্থার উপরে ভরসা থাকবে সকলের।''