পাহাড়ের নিচে ১০ কোটি বছরের জীবাশ্ম, বীরভূমে ঐতিহাসিক খোঁজ


বীরভূমেরপাহাড়ের পাদদেশ থেকে তুলে আনা কয়েক কোটি বছরের জীবাশ্ম এখন রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংহগ্রহশালায়। সেটিকে ঘিরেই এখন যত জল্পনা। গবেষণার কাজ নতুন পথে বাঁক নেওয়ার অপেক্ষায় অধ্যাপক এবং ছাত্রছাত্রীরা। শুধু তাই নয়, ওই বিস্ময়কর প্রাগৈতিহাসিক সময়ের সাক্ষী পরখ করতে রোজ ভিড় জমছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে। কেন এমনটা হবে না? এমন নমুনা সংগ্রহের উদ্যোগ উত্তরের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই প্রথম। কিন্তু কেমন করে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক মহলের নজরে এল এই অমূল্য সম্পদ?

সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনি। জুন মাসের গোড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একদল ছাত্রছাত্রী ফিল্ড এক্সকারশনে বীরভূমের রাজমহল পাহাড়ে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রেজিস্ট্রার দুর্লভ সরকার গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। ওই গাড়িতে অধ্যাপিকা রুমকি সরকারের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীরা রাজমহল পাহাড়ের উদ্দশ্য রওনা দেন। সঙ্গে ছিলেন আরও দুই স্কলার অধ্যাপক জয়জিৎ দেবনাথ এবং অরিন্দম দত্ত। জঙ্গলঘেরা পাহাড়ে পৌঁছে শুরু হয় সমীক্ষা ও অনুসন্ধানের কাজ। এই সময় পাহাড়ের পাদদেশে পাথরের মতো কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে ছাত্রছাত্রীরা হইচই শুরু করেন। অনেক খতিয়ে দেখার পর রুমকিদেবী নিশ্চিত হন এটি ভূ-বিদ্যার মুক্তো। সুদূর ইতিহাসের সাক্ষী ফসিল অর্থাৎ জীবাশ্ম। এরপরই সব কাজ ফেলে সেটি সংগ্রহের চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। লোকজন জোগাড় করে তুলে আনতে গিয়ে কয়েক টুকরো হয়ে যায় ফসিল। বছরের পর বছর অনাদরে পড়ে থাকা সেই সম্পদ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের সংগ্রহশালার প্রধান আকর্ষণ হয়েছে।

জীবাশ্মটির প্রাথমিক পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, রিইউনিয়ন অর্থাৎ হট স্পষ্ট থেকে ডেকান ট্র্যাপের লাভায় মালভূমি তৈরি হয়েছে। কেরগুয়েরলেন হট স্পষ্ট থেকেই রাজমহল ট্রাপের সৃষ্টি। সেটাই এখন রাজমহল পাহাড় নামে পরিচিত। অধ্যাপকা রুমকি সরকার জানিয়েছেন, চার বছর আগে একবার রাজমহল পহাড়ে জীবাশ্মের খোঁজ মিলেছিল। কিন্তু এবার সেই জীবাশ্ম সংগ্রহ করা সম্ভব হল। জীবাশ্মটি উদ্ভিদের। সেটি কত বছরের প্রাচীন তা নিয়ে শুরু হয়েছে অনুসন্ধান। প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে, আনুমানিক সাড়ে ছয় কোটি বছর থেকে সাড়ে দশ কোটি বছরের প্রাচীন হতে পারে এই ফসিল। সঠিক সময় জানতে 'জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'র বিজ্ঞানীদের কাছে নমুনা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল বিভাগের গবেষকরা জানিয়েছেন, উদ্ভিদ জীবাশ্মের বয়স জানাতে কার্বন এবং ইউরেনিয়াম ডেটিং পরীক্ষার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম ডেটিংয়ের সাহায্য নেওয়া হবে। কারণ, ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার বছর পুরনো কিছুর বয়স নির্ধারণ হয় কার্বন ডেটিংয়ে। এক মিলিয়ন থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়নের বেশি সময় হলে সেক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম ডেটিংয়ের প্রয়োজন। সেটাই করা হবে।

ভূ-গবেষকদের সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় সাড়ে দশ কোটি বছর আগে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে তৈরি হয় রাজমহল পাহাড়। এরপর সেখানে গাছপালার জন্ম হয়। কিন্তু ফের জেগে ওঠে আগ্নেয়গিরি। লাভায় আগুনের গাছপালা সবই তলিয়ে যায়। হয়ে ওঠে জীবাশ্ম। গবেষণায় জানা গিয়েছে, রাজমহল পাহাড়ে অন্তত দশবার আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠার ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে পাহাড়ে দশটি স্তরের সৃষ্টি হয়। কিন্তু কেন এখানে হঠাৎ জেগে ওঠে আগ্নেয়াগিরি? গবেষকদের মতে এর কারণ, 'টেকটনিক অ্যাক্টিভিটি'। ভূস্তরের নিচে রয়েছে বেশকিছু প্লেট। সেগুলি গলিত পদার্থের প্রভাবে নড়েচড়ে যায়। নড়াচড়ায় প্লেটগুলি সীমানার এলাকা থেকে প্রায়ই উপরের দিকে উঠে আসে লাভা, ধোঁয়া ও ধুলো। প্লেটগুলি সব সময় সমান্তরাল ভাবে নড়াচড়া করে। একটি প্লেটের অংশ অন্য প্লেটের নিচে ঢুকে পড়ে। এই প্রক্রিয়ার নাম সাবডাকশন। এখানেই ঢুকে পড়ে গাছ। সেই গাছই জীবাশ্ম হয়েছে। ওই কারণে সংগ্রহ করা জীবাশ্মে অতীতের অনেক ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন গবেষক মহল। সঠিক গবেষণার মাধ্যমে জানা সম্ভব হবে আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠার সময় থেকে অনেক কিছুই। এখন সেদিকেই তাকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়।