ব্যস্ত রাজপথই তিন ভাইবোনের রিডিং রুম


রাস্তার উল্টোদিকে টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো। খানিকটা এগোলেই জাপান কনস্যুলেট। রাস্তার দুই ধার দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটছে বাস, ট্যাক্সি, বাইক। কিন্তু ওদের সে দিকে নজর নেই। রাজপথের ধারে বসে চোখ বইয়ের পাতায়। দ্রুতগতির গাড়ির বিপদকে যেন ভ্রুক্ষেপ নেই ওদের। করুণময়ীর দিক থেকে টালিগঞ্জে মেট্রোর দিকে নিত্য যাদের যাতায়াত, সূর্য ঢললেই তাঁরা দেখতে পাবেন ওদের। কৌতুহলবশতই নেমে পড়েছিলাম গাড়ি থেকে। কাছে যেতে দেখলাম, একরত্তি দুই ভাইবোন ব্যস্ত স্কুলের 'হোম টাস্ক' নিয়ে। টালিগঞ্জ অশোকনগর স্কুলের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাঁদ ও পূজার জন্য রাজপথই 'রিডিং রুম'। বড় দাদা সূরজও ওই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়া। একই ভাবে রাস্তায় বসে পড়ে সে। বেপরোয়া চালকদের দৌরাত্ম্যে শহরে কোনও না কোনও প্রান্তে রোজ দুর্ঘটনার লেগেই থাকে। সেখানে এভাবে বিপদ মাথায় নিয়ে রাস্তা বসে ছোটছোট ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশোনা--- স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জেগেছিল, কেন? সহজপাঠের পাতায় চোখ রেখেই চাঁদ গড়গড় করে বলল, 'ঘরে আলো ঢোকে না। খুব গরম।' পুজা জানাল, ভোর থাকতে বাবা-মা বেরিয়ে যান কাগজ কুড়োতে। তিন ভাইবোন ঘুম থেকে উঠে নিজেরাই যায় স্কুলে। দুপুরে কোনও রকম কিছু জুটলে খাওয়াদাওয়া। তারপর বিকেলে রাস্তাতেই বসে যায় পড়াশোনা করতে।

ওরা যাকে ঘর বলছে, সেটা অবশ্য ঘর নয়। ফুটপাথে রেলিং ধারে এক ঝলক দেখলে মনে হয় প্লাস্টিকের মশারি টানানো রয়েছে। ছোট্ট একটা ঝুপড়ি। আলো ঢোকা দূরঅস্ত, নেই বাতাস ঢোকার পথও। নোংরা আবর্জনায় ভরা ফুটপাথ। তবু পড়ার তাগিদে বইপত্র নিয়ে প্রতিদিন ছুটন্ত গাড়ির চাকাকে উপেক্ষা করে রাস্তায় বসে পড়ে এরা। ছুটে যাওয়া গাড়ি দেখে ভয় করে না? চাঁদ-পূজার সরল জবাব, 'ধারে বসে পড়ি তো।' 

ওদের তিনজনকে নিয়ে ওই ঝুপড়িতে দিন গুজরান মামন ও রাজকুমার রাজের। টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ার ফুটপাতেই ওদের তিনজনের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। ভোর হতেই ছেলে-মেয়েকে রেখে বাবা-মা বেরিয়ে পড়েন কাগজ কুড়োতে। নিজেরা যত কষ্টই করুন, সন্তানদের পড়াতে চান। কিন্তু পয়সা নেই, কোনওরকমে দৌড়ঝাঁপ করে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন মামন। কিন্তু ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বসে পড়াশোনা করে, ঝুঁকি তো। উৎকন্ঠা আর অসহায়তা নিয়ে দম্পতির উত্তর, 'জানি, কিন্তু কী করব...'। 

দুপুরের রোদ কমতেই পড়তে বসে চাঁদ, পূজা, সূরজরা। বিকেলের সঙ্গেই জ্বলে ওঠে রাস্তার আলো। হোমওয়ার্ক শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে পড়া। ছেঁড়া-নোংরা জামা গায়ে পূজাদের, ঝুপড়িতে চোখে পড়ল না কোনও খেলনা। তবু তাদের কী চাই জিজ্ঞেস করতেই খেলনা বা খাবারের আবাদার করল না তারা। পূজা জানাল, তার খাতা শেষ হয়ে গিয়েছে। চাঁদের বক্তব্য, একটা পেনসিল চাই তার। 

ছেলে-মেয়েকে সাফল্য চূড়ায় দেখতে তাদের প্রয়োজন মেটাতে কোনও খামতি রাখতে চান না বাবা-মায়েরা। নামী স্কুল, একাধিক শিক্ষক, কম্পিউটার--- সব দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে ব্যস্ত তাঁরা। মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেলে দুঃস্থ-মেধাবীদের ছবি বেরোয় সংবাদমাধ্যমে। এরা সেই বয়স ও শ্রেণি থেকে অনেক দূরে। তবু এদের পড়ার প্রতি একাগ্রতা, মনোযোগ কি কোনও অংশে কম? ঘরে শুধু তিন জনের তিনটি স্কুলের ব্যাগ। নেই অনেক কিছুই। 

তবু কলকাতার রাজপথে নিয়ন আলোর মাঝে ঝলমল করে ওরা।