পুণেতে কে খুন করেছিল বাঙালি মেয়ে অন্তরাকে?


নি্হত অন্তরা দাস।
নিহত অন্তরা দাসের যমজ বোন ও মা।

সেই রাতের কথা এখনও মনে আছে সঞ্চারীর। বোনের মোবাইলে ফোন করতেই সেটা ধরলেন হাসপাতালের এক চিকিৎসক।তিনি জানালেন...
পুণেতে এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করতেন অন্তরা দাস। সঞ্চারী অন্তরারই যমজ দিদি। অন্তরার থেকে কয়েক মিনিটের বড়।বুধবার সরশুনায় নিজের ফ্ল্যাটে বসে সঞ্চারী বললেন,"প্রতিদিন ও অফিস থেকে বেরিয়েই ফোন করত। সেদিন রাত সওয়া ন'টা বেজে গেলেও ফোন না আসায়, আমার মোবাইল থেকেই মা ফোন করে। রিং হওয়া মাত্র উল্টোদিকে ফোনটা তুলেছিলেন হাসপাতালের ডাক্তার।''

ওই চিকিৎসক তাঁদের জানিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসতে। কারণ, বোন নাকি খুবই অসুস্থ। তত ক্ষণে যে সব শেষ হয়ে গিয়েছে, তা বুঝতে পারেননি সঞ্চারীরা।

খুনি সন্দেহে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু, তিনি জামিন পেয়ে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, আর কিছু দিনের মধ্যেই আদালত তাঁকে খুনের মামলা থেকে অব্যহতিও দেবে। সে কথা মেনে নিচিছেন পুণের পুলিশ কর্তারাও।কারণ, পুলি‌শ তাঁর বিরুদ্ধে কোনও তথ্য-প্রমাণ আদালতে পেশ করতে পারেনি।

আর তাই খুনের প্রায় দু'বছর পরেও অধরা সরশুনা বাসুদেবপুরের বাসিন্দা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী অন্তরা দাসের খুনি।পুণেতে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি পেয়েছিলেন ২৩ বছরের অন্তরা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৩ তারিখ। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি ফেরার সময় অফিস থেকে সামান্য দূরে বাসস্ট্যান্ডের কাছে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে অন্তরাকে। পথচলতি এক বাইক আরোহী রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে দেখে হাসপাতালে পৌঁছে দেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

পুণে পৌঁছেই দাস পরিবারের প্রথম সন্দেহ হয় বিহারের বাসিন্দা সন্তোষ কুমারের গুপ্তর উপর। অন্তরার মা শিপ্রা দেবী বলেন,"আমার ছোট মেয়ে সব কথা দিদিকে বলত। পুণেতে চাকরি পাওয়ার আগে, বেঙ্গালুরুতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল অন্তরা। সেই সময় সন্তোষও সেখানে প্রশিক্ষণ নেন। আর সেই সূত্রেই অন্তরার সঙ্গে তাঁর আলাপ।'' তিনি আরও বলেন, ''এর পর অন্তরা পুণেতে চলে আসার পর প্রায়ই ওকে ফোন, এসএমএস এবং হোয়াটসঅ্যাপে বিরক্ত করত সন্তোষ। দিদিকে এসব ঘটনা জানিয়েছিল ছোট মেয়ে।" আর এ সব কারণেই পুণে পুলিশকে সন্তোষের কথা জানিয়েছিল দাস পরিবার।

ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই সন্তোষকে বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশও দাবি করেছিল, ধৃত সন্তোষ এই খুনের সঙ্গে যুক্ত।কিন্তু সে নিজে খুনের দিন বেঙ্গালুরুতেই বসে ছিল। সম্ভবত কোনও ভাড়াটে খুনিকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে সন্তোষ।

অপরাধী ধরা পড়েছে ভেবে নিশ্চিন্ত মনেই কলকাতায় ফিরে আসেন অন্তরার বাবা দেবানন্দবাবু। কিন্তু তার কয়েক মাস পরেই তাঁদের ভুল ভাঙে। শিপ্রা দেবী বলেন, "ঘটনার সাত মাস পরেও পুলিশ জানায় তাঁরা নাকি অন্তরার ল্যাপটপ আর ফোনের পাসওয়ার্ডই খুলতে পারেনি।"

রাজ্য ভূমি রাজস্ব দফতরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী দেবানন্দ তড়িঘড়ি ছোটেন পুণেতে। ততদিনে পুলিশ কর্তারাও বদলি হয়ে গিয়েছেন। শিপ্রা বলেন,"নতুন পুলিশ সুপারকে আমরা সব কিছু জানাই। তিনি আশ্বাস দেন যে তাঁরা দ্রুত বাকি অপরাধীদেরও গ্রেফতার করবেন।" কিন্তু আশ্বাসই সার। এখন পর্যন্ত সুপারি কিলার ধরা পড়েনি, উল্টে সন্তোষের বিরুদ্ধেও কোনও তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে পারেননি তদন্তকারীরা।

অথচ দাস পরিবারের দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁদের মেয়েকে খুনের পেছনে ওই সন্তোষের ভূমিকা আছে। চেন্নাইতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন অন্তরার বাবা দেবানন্দ। সেখান থেকে তিনি ফোনে বলেন,"সন্তোষ যে আমার মেয়েকে বিরক্ত করছিল, তা সে নিজে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। সে এটাও স্বীকার করেছে যে, আমার মেয়ে পুণেতে চাকরি পাওয়ার পর সে নিজেও এসেছিল মেয়ের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য।"

খুনিকে গ্রেফতারের আর্জি নিয়ে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস থেকে শুরু করে এ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তথা শাসকদলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়— সবার কাছেই গিয়েছেন। কিন্তু খুনি ধরা পড়েনি।

প্রায় আড়াই কাঠা জমির উপর দাস পরিবারের বাড়ি। সেই বাড়িতে কেউ থাকেন না। প্রায় পোড়ো বাড়ির চেহারা নিয়েছে। মেয়ে সঞ্চারীকে নিয়ে পাড়ারই একটি আবাসনে ভাড়ার ফ্ল্যাটে দিন কাটান দেবানন্দ-শিপ্রা। গত দেড় বছরে দু'বার ফ্ল্যাট বদলেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই ফুঁপিয়ে ওঠেন সঞ্চারী। বলেন, "বোনকে ছাড়া ওই বাড়িতে আমি থাকতে পারিনা।আমার বোনটা কি বিচার পাবে না?"

মেয়ের খুনি শাস্তি পাবে এই আশাতেই এখন দিন কাটাচ্ছেন দাস দম্পতি।