নিজের দেশেই উদ্বাস্তু ৪০ লক্ষ, বাঙালি খেদাও চলছে, তীব্র তোপ মমতার


অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মুখ্যমন্ত্রী সোমবার প্রশ্ন তুললেন, ''অসম থেকে বাঙালিদের জোর করে তাড়ানো হচ্ছে না তো? ১৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী কেন নামানো হল? বুলডোজ করা হবে না তো?'' কেন প্রায় গোটা অসম জুড়ে ইন্টারনেট পরিষেবা অচল করে দেওয়া হয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে প্রশ্নও তুলেছেন। দেশের মধ্যেই ৪০ লক্ষ লোককে উদ্বাস্তু বানিয়ে দেওয়া হল বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

বৈধ পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও জাতীয় নাগরিকপঞ্জির খসড়ায় নাম ওঠেনি অনেকেরই— দাবি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি কয়েক জনের আধার কার্ড ও পাসপোর্টের প্রতিলিপি দেখিয়ে দাবি করেন, এনআরসি-তে তাঁদের নাম ওঠেনি।

জাতীয় নাগরিক পঞ্জির খসড়া আগেও প্রকাশ করা হয়েছিল অসমে। তাতেও অনেকের নামই বাদ পড়েছিল। তবে সে খসড়া চূড়ান্ত ছিল না। ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ নথি থাকা সত্ত্বেও যাঁদের নাম বাদ পড়েছিল, তাঁরা পরের দফার খসড়ায় এনআরসি-র অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন বলে জানানো হয়েছিল। এ দিন অসমের রাজধানী দিসপুরে সাংবাদিক বৈঠক করে নতুন খসড়াটি প্রকাশ করা হয়। প্রায় ৪০ লক্ষ অসমবাসীর নাম সে তালিকা থাকে বাদ পড়েছে। প্রায় ৩ কোটি ৩০ লক্ষ আবেদনকারীর মধ্যে ২ কোটি ৯০ লক্ষের নাম খসড়া তালিকাটির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে এনআরসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এই তালিকা চূড়ান্ত নয়, এটিও খসড়া। যাঁদের নাম বাদ পড়ল, তাঁরা আবার বৈধ নথিপত্র-সহ আবেদন জমা দিতে পারবেন বলে জানানো হয়েছে।

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছেন, অসমে এখন বাঙালি খেদাও চলছে, বিহারি খেদাও চলছে। নির্বাচনী রাজনীতি করতে গিয়ে অসমের বিজেপি সরকার অকারণ প্ররোচনা তৈরি করছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইঙ্গিত।কেন্দ্রীয় সরকার নীরব থেকে অসমের সরকারকে সে কাজে সাহায্য করছে বলেও তিনি মনে করছেন। অসমে যে প্রক্রিয়ায় এনআরসি তৈরি হচ্ছে, তাকে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার অসম সরকারের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি। জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

যে ৪০ লক্ষ নাম তালিকায় ওঠেনি, তাঁদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম সব ধর্মের বাঙালিই রয়েছেন বলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। বিহার থেকে অসমে যাওয়া অনেকের নামও তালিকায় রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। অসম থেকে এঁদের তাড়ানো হলে বাংলার উপরে এবং বাংলাদেশের উপরে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়বে বলে মুখ্যমন্ত্রীর আশঙ্কা। তিনি বলেন, ''আমি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মিডিয়ার মাধ্যমেই আবেদন জানাচ্ছি, এঁদের বাঁচান। এঁদের বিচ্ছিন্ন করবেন না।'' ৪০ লক্ষ লোক 'দেশের মধ্যে থেকেই উদ্বাস্তু হয়ে গেলেন' বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন। বিষয়টি যে তিনি চুপচাপ দেখবেন না, এ নিয়ে যে তিনি অনেক দূর যাবেন, তা-ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ''আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সময় চাইব। আমি নিজে দেখা করে কথা বলব।'' অসমের পরিস্থিতি দেখে আসার জন্য তৃণমূলের তরফ থেকে সংসদীয় দল পাঠানো হবে বলে মমতা জানিয়েছেন। প্রয়োজন হলে তিনি নিজেও অসম যেতে পারেন, জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।

যাঁদের নাম এই দফায় এনআরসি-তে উঠল না, তাঁরা নাগরিকত্ব হারালেন, এমনটা কিন্তু নয়— জানিয়েছেন এনআরসি কর্তৃপক্ষ। নানা দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় বহু নথি নষ্ট হয়েছে বলে এনআরসি কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে। তাই যাঁদের নাম এ দফাতেও এনআরসি-তে ওঠেনি, তাঁদের নতুন করে আবেদন করতে বলা হয়েছে। যতক্ষণ না চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হচ্ছে, ততক্ষণ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে এবং কাউকেই অসম থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করা যাবে না বলে এনআরসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। অকারণ হামলা রুখতেই বিভিন্ন জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো হয়েছে বলে অসমের প্রশাসন জানাচ্ছে। কার নাম তালিকায় রইল, আর কার নাম উঠল না, সে তথ্য যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ জানতে না পারেন, তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে এনআরসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

তবে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, এই এনআরসি-কে ব্যবহার করে ফের একটা বাঙালি খেদাও-এর মুখোমুখি হতে চলেছে অসম। যদি অসম থেকে বিতাড়িত হয়ে কেউ বাংলায় আশ্রয় চায়, তা হলে রাজ্য সরকার ভেবে দেখবে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশিকা অনুসারে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া বাধ্যতামূলক বলেও তিনি জানিয়েছেন। অসমের নাগরিকপঞ্জি থেকে যদি বিপুল সংখ্যক নাম বাদ পড়ে, তা হলে বাংলার উপরেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে জানা সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও আলোচনা তাঁর সঙ্গে করেনি,অভিযোগ মমতার। অসম সরকারের পাশাপাশি এ দিন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।