সন্ত্রাস ছেড়ে সঙ্গীতে, নজির কাশ্মীরি গায়কের


প্রায় ৭০ বছর আগে কাশ্মীরি কবি গুলাম আহমেদ মেহজুর লিখেছিলেন লোকগীতিটা। 'হা গুলো'। মানে, 'ও ফুল'! প্রেম-বিরহের সেই গানই দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে উপত্যকার গণ্ডি পেরিয়ে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে। সৌজন্যে পাকিস্তানের 'কোক স্টুডিয়ো এক্সপ্লোরার'। 'ক্লিক' বাড়ছে ইউটিউবে। সঙ্গীতপ্রেমীরা চিনে নিচ্ছেন ওই লোকগীতির গায়ক, মহম্মদ আলতাফ মিরকে।

কারুশিল্পী ছিলেন মির। সব ছেড়েছুড়ে হয়ে গিয়েছিলেন জঙ্গি। এখন তিনি সঙ্গীতশিল্পী। নতুন রূপে 'হা গুলো'-র প্রধান গায়ক। গত ৩ জুলাই পাকিস্তানে মুক্তি পেয়েছে সঙ্গীত অনুষ্ঠানটির নয়া সংস্করণ। আর মাত্র দু'দিনেই 'হা গুলো'-র দর্শকসংখ্যা দেড় লক্ষ ছাড়িয়েছে।

আরও একটা বদল হয়েছে মিরের জীবনে। আদপে কাশ্মীরের অনন্তনাগের মানুষ তিনি। জীবন তাঁকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের মুজফ্ফরাবাদে। স্ত্রী, চার সন্তান-নিয়ে সেখানেই এখন সংসার তাঁর।

অনন্তনাগের জংলত মান্ডিতে থাকার সময়ে নির্ঝঞ্ঝাটেই দিন কাটত মিরের। কাপড়ের উপর আড়ির কাজ ও নানা রকম সেলাই করেই রোজগার হত। গানের গলাটা ছিলই। বিয়েবাড়ি, সুফিয়ানা মেহফিলের মতো নানা অনুষ্ঠানেও গাইতেন। নামও হয়েছিল বেশ।

এই সময়টাতেই অনেক কিছু বদল হচ্ছিল মিরের চারপাশে। দেখছিলেন, সেনার সঙ্গে ঝামেলা বাধছে কাশ্মীরে। বন্দুকের গর্জনে ঢাকা পড়ছে সুর। তার পর এক দিন মিরের মনটাও পাল্টে যায়। ঠিক করেন, অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে যাবেন পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে। ১৯৯০-এ শরতের এক সকালে বাড়ি ছাড়েন তিনি। এত দিনের সুচ-সুতো ধরা হাতে ওঠে একে-৪৭!

মিরের ভাইপো মহম্মদ ইকবাল শাহ বলছিলেন, ''পাঁচ বছর হদিস ছিল না কাকার। শুধু জানতাম, পাকিস্তানে আছেন।'' ১৯৯৫-এর এক বিকেলে হঠাৎ বাড়িতে কান্নাকাটি। আনন্দাশ্রু। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন মির। কিন্তু চলে গিয়েছিলেন দু'ঘণ্টা পরেই।

মির বুঝতে পারছিলেন, জঙ্গি হয়ে বাঁচা মুশকিল। সরকারি মদতপুষ্ট 'ইখওয়ান' বাহিনীর দাপটে তাঁদের জঙ্গি-দল 'আল উমর' তখন কোণঠাসা। বছরখানেক লুকিয়ে থাকেন মির। ১৯৯৬-এর মাঝামাঝি নাগাদ ফের পালান পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে। একা-একাই।

মুজফ্‌ফরাবাদ গিয়ে নতুন করে জীবন শুরুর সিদ্ধান্ত। রুজির টানে সেলাই, সেই সঙ্গে কাশ্মীরি লোকগীতির সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কটাকেও আবার খুঁজে বার করা। ২০০০ সালে বিয়ে। ২০১৫-য় সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আবার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ। ইতিমধ্যেই ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে ছেলের কাছে ঘুরে গিয়েছেন মা।

এ সবের মধ্যেই গানের দল গড়া। মিরের ব্যান্ডের নাম 'ক্যাসামির'। ২০১৭-য় নতুন প্রতিভার খোঁজ শুরু করে গানের চ্যানেলটি। অনেকেই বলেছেন, কাশ্মীরি গানের স্তম্ভ হাসান সফি, রাজ বেগমের সময়কার ছোঁয়া পেয়েছেন 'হা গুলো'-র মিউজ়িক ভিডিয়োয়। মির ও তাঁর সহ-গায়কদের পরনে কাশ্মীরি ফিরন ও সাবেকি টুপি। ভিডিয়োয় ভূস্বর্গের নৈসর্গিক সৌন্দর্যটাও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন প্রযোজকেরা। গান তৈরি হওয়ার ভিডিয়োয় মির বলেছেন, ''আমি একদমই নাচি না। কিন্তু আজ প্রথম বার নাচলাম। আমার স্বপ্ন সত্যি হল!''