কাজু-চিপসের আবদার ছেড়ে টিফিনে স্রেফ চপ-মুড়ি, তৃণমূলে ব্যয় সংকোচের বার্তা


চা খেতে চাইলে কড়ি খসাতে হবে নিজের ট্যাঁক থেকে। সভা চলাকালীন টিফিন চাইলে চপ-মুড়ি, নিদেনপক্ষে মিলতে পারে সামান্য মুখরোচকের বিরতি। কাজু-চিপসের আবদার তো আর নৈব নৈব চ!

গলির আনাচকানাচে বাঁধা যাবে না বাড়তি মাইক। বানানো যাবে না রাস্তাজোড়া ঢাউস গেটও। বড় জনসভা হোক বা কর্মিসভা- অতিথি আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি বন্ধে অলিখিত নির্দেশিকা জারি হয়ে গেল তৃণমূলের অন্দরে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তরবঙ্গে গিয়েও সেই নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দেখানো পথেই মন্ত্রীদের মাধ্যমে তাঁদের বিধানসভা এলাকা ও সরকারি সব কর্মসূচির ক্ষেত্রেই এই নির্দেশিকা মেনেই এবার থেকে চলতে হবে দপ্তরগুলিকে।

কলকাতা ও লাগোয়া জেলা হোক বা উত্তর ও মধ্যবঙ্গের মন্ত্রীরা একযোগে তাঁদের সচিব মারফৎ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের কথা দপ্তরে জানিয়ে দিয়েছেন। নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছে দলের কর্মীদের কাছেও। মন্ত্রিসভার এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জানিয়েছেন, "মুখ্যমন্ত্রী কখনওই কোনও কিছুতে বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না। সরকারি সভার খরচ কখনওই চোখে লাগার মতো করা হত না। তার পরেও কোথাও কোথাও বাড়তি খরচ হয়েই যেত। একটু স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে স্টেজের সামনে কাগজের ফুল, ফুলের মোটা স্তবক, উত্তরীয়, ব্যাজ এসব তো রেওয়াজই হয়ে গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এসব অযথা খরচের কোনও দরকারই নেই।"

মমতার বার্তার গভীর প্রভাব পড়েছে তাঁর দলে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি তথা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়ি মল্লিক যেমন জানিয়েছেন, "দলীয় সভা-সমিতি করতে চাইলে প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে সবচেয়ে কম খরচে কীভাবে তা করা যায়। তাতে অনেকের কাছে খারাপ হতে হবে। কিন্তু দলনেত্রীর নির্দেশের কাছে সেসব কিছুই না।"

সম্প্রতি নিজের এলাকায় কৃতী ছাত্রছাত্রীদের হাতে ক'টি ট্যাব তুলে দিয়েছেন মন্ত্রী। স্থানীয় পুরসভা প্রথমে সেই আয়োজন করতে চাইলেও, তাতে রাজি হননি। নিজের বেতন থেকেই দিয়েছেন ট্যাবের খরচ। এই জেলারই আরও এক মন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন সিনিয়র কিছু নেতার আবদারের কথা। বলছেন, "এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের পছন্দের কথা মাথায় রেখে একটা সময় ভাল চা, কাজু বা চিপস রাখতে হত। তা ছাড়া দলীয় সভায় মধ্যপন্থী কর্মীদের জন্যও থাকত উত্তরীয়, ব্যাজ, ফুলের তোড়ার ব্যবস্থা। এসব করার তো কোনও অর্থই নেই। এখন থেকে গোটাটাই বন্ধ।"

সব মানা গেলেও 'চা' বাদের কথা মেনে নিতে আপত্তি জানিয়েছেন হুগলির এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ক'জন নেতা। মন্ত্রী তবে নিজে জানাচ্ছেন, "৫০ জনের জন্য ভাল চায়ের খরচ বাবদ ৫০০ টাকা ধরে নেওয়াই যেত। কিন্তু তা কখনওই থাকে না। যার মাধ্যমে সেই চায়ের অর্ডার দেওয়া হল, দেখা গেল শেষ পর্যন্ত তিনি বিল পাঠালেন ৪ হাজার টাকার। এটা তো দিনে ডাকাতি। কোনও হিসাবই থাকত না। এ নিয়ে অসন্তোষ তো ছিলই। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় সেসবে অনায়াসে টান দেওয়া গেল। কেউ চা খেতে চাইলে, এবার থেকে তাঁকেই খাওয়াতে হবে।"

এমন কড়া নিদানে কাজও দিয়েছে। ২১ জুলাইকে কেন্দ্র করে জেলায় জেলায় একাধিক প্রস্তুতি সভা চলছে। রক্তদান শিবিরেও দেদার মাইক বাজানো নিয়ে ক্ষোভ উঠে আসছিল। মমতার নির্দেশের পর দিন থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে উত্তরীয়, ব্যাজ, ফুলের তোড়া। বাড়তি মাইক লাগানোও বন্ধ। সভাশেষে সামান্য কাগজের কাপে চা খেয়ে গলা ভেজাতে হচ্ছে। মেদিনীপুরের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র যেমন জানিয়েছেন, "মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ আমার সচিবকে জানিয়ে দিয়েছি। দপ্তর থেকেই এবার গোটা প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রিত হবে।"

কিন্তু সভার খরচ কমালে কি কর্মীদের আনাগোনা কমে যাবে না? উত্তরবঙ্গের এক জেলার সভাপতি সরাসরি নাকচ করেছেন সে কথা। বলছেন, "সৎ এবং একনিষ্ঠ কর্মীরা কখনই তা করবেন না। মাথায় রাখতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শই আমাদের দলের মূল কথা।" দক্ষিণের এক জেলার সভাপতিও বলছেন, "দলের কাজ না থাকলে গ্রামে গ্রামে এমনিতেই লোকের সাইকেল-বাইকে ঘুরি। দলনেত্রীর বলে দেওয়ার পর অঢেল খরচ করে বাহুল্য দেখানোর আর কোনও সুযোগ রইল না।"