১৪ বছর পর খালাস পেলেন মৃত বিমলেন্দু


তাঁর যাবজ্জীবন জেল খাটার কথা। খেটেও ফেলেছেন ১২ বছর। সোমবার হাইকোর্ট জানাল, তিনি অপরাধীই নন। বেকসুর খালাস। 
তাঁর ছুটি। কত বছর পর আকাশ দেখবেন। হয়তো ভিজবেন বৃষ্টিতে। দেরিতে হলেও বিচার তো মিলল। কিন্তু কে পাবেন বিচার? 
তিনি তো বেঁচেই নেই। বছর দুয়েক আগে জীবন থেকে ছুটি নিয়েছেন। আদালত জানেই না তিনি মৃত। অথচ মামলা চলেছে। 

বিমলেন্দু মণ্ডল ওরফে বিমলকে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দিয়েছিল বাঁকুড়া আদালত। স্ত্রীকে খুনের দায়ে। তখন ২০০৪ সাল। নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরেই হাইকোর্টে যান বিমলেন্দু। কিন্তু ওই অব্দিই। আইনজীবী দাঁড় করানোর ক্ষমতা ছিল না। ফলে ১৩ বছর পর মামলা যখন ওঠে, তখন কাগজপত্র হলুদ হয়ে এসেছে। হাইকোর্টই এক আইনজীবীকে বিনা পয়সায় মামলা লড়ার জন্য অনুরোধ করে। তিনি রাজিও হন। তাঁর বিপক্ষে দাঁড়ান সরকারি আইনজীবী। এক জন সওয়াল করেছেন নিম্ন আদালতের রায়ের পক্ষে। আর এক জন বিপক্ষে। অথচ কেউই জানেন না মক্কেল আর বেঁচে নেই। আদালতও অভিযুক্তকে সশরীরে হাজির হতে বলেনি। সোমবার বিচারপতি মুমতাজ খান ও বিচারপতি জয় সেনগুপ্তর ডিভিশন বেঞ্চ বিমলেন্দুকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করে। নিম্ন আদালতের একাধিক ত্রুটিও তুলে ধরেন বিচারপতিরা।

সরকারি তথ্য বলছে, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বিমলকে ভর্তি করানো হয়েছিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেখানেই তিনি মারা যান। কিন্তু মামলা ওঠে ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সোমবার যখন তিনি খালাস পেলেন, তখন খোঁজ শুরু হল কার দোষে তিনি এত বছর জেল খাটলেন? এত বছর পর মামলাই বা উঠল কেন? এ-সব খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে এল সেই ভয়ঙ্কর সংবাদ---বিমল তো বেঁচেই নেই। 

বাঁকুড়ার কোতুলপুর থানার কনকবেড়িয়ার বিমলের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী অণিমা ঘোষের প্রায়ই গোলমাল হত। ২০০২ সালের ১৩ অগস্ট ভোরে বাড়ির পাশেই একটি ডোবায় অণিমার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট জানায়, বুকে-মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পাকস্থলিতে আছে বিষ। তিন দিন পরে মৃতার ভাই শিবেন্দ্র ঘোষ থানায় জামাইবাবুর নামে দিদিকে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, ১২ অগস্ট সকালেও দিদির বাড়িতে গিয়ে দু'জনের মধ্যে গোলমাল টের পেয়েছেন। এমনকী দিদিকে মারার চিহ্নও তিনি দেখেছেন। বাঁকুড়া আদালত ২০০৪ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর স্ত্রীকে খুনের দায়ে বিমল ওরফে বিমলেন্দুর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করে। 

ওই বছরেই বিমল ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করেন। জামিনের আবেদনও জানান হাইকোর্টে। কিন্তু আদালত জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ফের মামলাটি ওঠে। কেন এতদিন মামলাটি ওঠেনি, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে আদালত। মামলার পেপার বুকও তৈরি করা হয়নি। সেটা করার কথা হাইকোর্টের কর্মীদের। এই অবস্থায় ডিভিশন বেঞ্চ আইনজীবী অপলক বসুকে অভিযুক্তের হয়ে লড়ার জন্য অনুরোধ করে। অভিযুক্তের কোনও আত্মীয়স্বজন কোনওদিন আসেননি। তাই আদালতের কাগজপত্র দেখেই সওয়াল করেন তরুণ ওই আইনজীবী। 

আদালত বিমলকে বেকসুর খালাস করতে গিয়ে যে প্রশ্নগুলি তুলেছে: এক, বাপের বাড়ির লোক সবসময় থাকলেও কেন দেহ পাওয়ার তিন দিন পরে এফআইআর করা হল। দুই, মৃতের ভাইয়ের সাক্ষ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য। তিন, মৃতার দেহ পাওয়া গেল বাড়ির পাশের ডোবায়। কিন্তু স্বামী তাঁকে মেরে সেখানে ফেলে এসেছে তার কোনও প্রমাণ নেই। চার, মৃতের সাত বছরের ছেলে সাক্ষ্য দিলেও সে থাকত মামার বাড়িতে। অভিযুক্তকে সাজা দেওয়ার আগে তার বক্তব্য জানতে চাইতে হয়। এখানে তেমন কোনও নথি নেই। 

কিন্তু এ-সব বলা হল কার জন্য? আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের সুপার শুভেন্দু ঘোষ রাতে বিভিন্ন নথি ঘেঁটে জানান, বিমল ওরফে বিমলেন্দু মণ্ডলকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়েছিল। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। 

অতএব বিচার পেলেন মৃত বিমল। ছুটিও পেলেন মৃত বিমলই। কত প্রশ্ন যে তিনি উস্কে দিলেন!