পাচারকারীদের ধরাতে লুকিয়ে কোর্টে সাহসিনী


'এ তো মেয়ে, মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়ই!' বেশি বলা হয়ে গেল মনে হচ্ছে! তা হলে বিচার করুন আপনারাই। 

১২ বছর বয়সে পাচার হয়ে যাওয়া, পরের পর স্টেরয়েড ইঞ্জেকশনের জ্বালা সহ্য করা, খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করা, ৫ বছর পরে পালিয়ে আসা, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া, অসুস্থ শরীরে লড়াই চালানো, স্বয়ংসিদ্ধার ক্যাম্পেনে রিসোর্স পার্সন হওয়া ও পাচারকারীর হানা-হুমকি তোয়াক্কা না করে বাড়ি থেকে দূরে থেকে কোর্টে হাজিরা দিয়ে পাচারকারীকে শাস্তি দেওয়া --- এ সবই তিনি করছেন একা হাতে। যে কেউ কী করতে পারবেন! 
রোশনি (নাম পরিবর্তিত) তাই দশভুজাই। 

এই মেয়ে এর আগেও পুনের ওই অন্ধকার দুনিয়া থেকে পালিয়ে আসতে চেষ্টা করেছিলেন। সফল হননি। কিন্তু হালও ছাড়েননি। চেষ্টা করতে করতেই এক দিন তিনি কোঠা ছেড়ে পালিয়ে আসতে পারেন রোশনি। সেটা ২০১৭ সাল। চলতে থাকে মামলা।

সেই মেয়েই বৃহস্পতিবার আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তাঁর উপর অত্যাচারের কথা ও তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে ক্রমাগত হুমকি দেওয়ার কথা। তিনি বিচারপতির কাছে পাচারকারীরা যাতে দ্রুত গ্রেপ্তার হয় ও শাস্তি পায়, সেই আবেদন জানিয়েছেন। 

রোশনির জেদ অদম্য। পাচারকারীকে শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালাচ্ছেন। এই সাহস চট করে দেখা যায় না। সোমবার রাতে পাচারকারী ও তার দলবল রোশনির বাড়িতে চড়াও হয়। শাসানি দিয়ে বলে, 'হাসপাতালে বেড খালি আছে। কেস না তুললে তোমাদের তক্তা করে ওখানে পাঠানো হবে।' কার্যত ওঁর বাড়ির লোকেরা ভয় বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। স্কুলে যাওয়াও বন্ধ রয়েছে রোশনির অন্য ভাই-বোনের। তাও তিনি ভয় পাচ্ছেন না। শাস্তি তিনি দেবেনই অপরাধীদের। নিজের উপর অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেনই। 

এই শাসানি অবশ্য রোশনির কাছে নতুন নয়। ২০১৭ সালে রোশনি ফিরে আসার পর থেকেই নানা ভাবে মামলা তোলার জন্য চাপ দিচ্ছে। বাসন্তী থানাতে একাধিকবার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও পাচারকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে খুল্লাম খুল্লা। সম্প্রতি ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। এ প্রসঙ্গে বারুইপুর পুলিশ জেলার এসপি অরিজিৎ সিনহা বলেন, 'এই নির্দিষ্ট ঘটনার অভিযোগ জানালে, পাচারকারীরা গ্রেপ্তার হবে। তাদের ছেড়ে রাখার প্রশ্নই নেই।' ইতিমধ্যেই অভিযোগ দায়ের হয়েছে। 

গল্পের শুরু আজ থেকে ৬ বছর আগে। স্কুলে যাওয়ার পথে বছর ১২-র মেয়েটিকে অপহরণ করেছিল তিন পাচারকারী। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পুনের যৌনপল্লিতে। সেখানে গিয়ে চলে অকথ্য অত্যাচার। রোশনি জানান, ১২ বছর বয়সে তাকে যাকে অন্তত ১৮-২০ বছর লাগে সে জন্য নির্বিচারে হরমোন ইঞ্জেকশন দেওয়া হত, যাতে শারীরিক বিকাশ দ্রুত হয়। তার কুফল তিনি বোঝেন গ্রামে ফিরে আসার পরে। এই গোত্রের ইঞ্জেকশন ওজনও বাড়িয়ে দেয়। রোশনির ক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছে। সে চিকিৎসাও চলছে এখন। 

রোশনি সেই সময় মানসিক ভাবেও বিধ্বস্ত ছিলেন। কিছুটা আত্মহত্যা প্রবণও বলা যায়। চিকিৎসার পরে তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ক্যানিংয়ের যে এনজিও-র মাধ্যমে রোশনি এখন একটা স্টেশনারি ব্যবসা করছেন এবং ট্র্যাফিক সারভাইভার গ্রুপ 'বন্ধনমুক্তি'র সদস্য হয়েছেন, সেই 'জিজিবিকে'-র পক্ষে শুভশ্রী রাপ্তান বলেন, 'আমাদের এখানে পাচার হয়ে ফিরে আসা মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন ভাবনাচিন্তা নেই। রোশনি মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত ছিল। এত বছর পরে ফিরে এসে সমাজে মানিয়ে নেওয়া ও সমাজের মেনে নেওয়া দু'টোই ছিল কঠিন। ওর চিকিৎসা করানোয় ও এখন সুস্থ। নিজের ব্যবসাও করছে। এমনকী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে বাড়ি থেকে অনেক দূরে আছে ও। কেউ যাতে ওর সন্ধান না পায়।' 

সে দিনের রোশনির সঙ্গে অবশ্য আজকের রোশনির কোনও মিল নেই। এই রোশনি তেজস্বিনী, ভয়ে কুঁকড়ে থাকা নাবালিকা নয়। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্বয়ংসিদ্ধা প্রকল্পের অন্যতম সেনানী তিনি। বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি সতর্ক করেন ভবিষ্যৎকে। তাঁর কথায় বিপদ-রোখার শক্তি পায় অন্যরা। আলোয় ফেরা মেয়েদের সামনে নিজেকে রেখে দেখান নতুন পথের দিশা। আশ্বাস দেন, এত সহজে হেরে যাওয়া যায় না। অসম্ভবকে সম্ভব করার নামই জীবন। 

এ ভাবেই রোশনির মধ্যে বেঁচে থাকে স্বয়ংসিদ্ধারা-সাহসিনী, তেজস্বিনী, বিপত্তারিণী। হাজারে হাজারে তৃতীয় নয়ন জেগে ওঠে।