বৃদ্ধকে নদী থেকে তুলে তলিয়ে গেলেন ১৯ বছরের তরুণ


উনিশ বছরের সুব্রত দাস

পঁচানব্বই বছরের জীবনটা বোধহয় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। পাশেই ছিল টগবগে উনিশ বছরের ছেলেটা। সে চেয়েছিল জীবন বাঁচাতে। ঝাঁপিয়েছিল বর্ষার ভরা নদীতে, ডুবতে বসা বৃদ্ধকে উদ্ধার করতে।

জীবন বাঁচিয়ে নিজে অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি উনিশ বছরের সুব্রত দাস। রবিবার সকালে নদিয়ায় কৃষ্ণগঞ্জে চূর্ণী নদীর উপরে এই ঘটনার সাক্ষী থাকলেন বহু মানুষ।

বৃদ্ধ তেঁতুল ঘোষ রবিবার সকালে নৌকা থেকে পড়ে যান চূর্ণী নদীতে। তাঁকে বাঁচাতে ঝাঁপ দেন সুব্রত। আর ওঠেননি। ডুবুরি নামিয়ে খোঁজাখুঁজি করেও রাত পর্যন্ত তাঁর সন্ধান মেলেনি। ঘটনার পর থেকে নদীর পাড়ে ভেঙে পড়েছে প্রায় গোটা গ্রাম। সকলেই প্রার্থনা করছেন, অত্যাশ্চর্য একটা কিছু ঘটুক। কোনও ভাবে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসুন সুব্রত।

যাঁকে বাঁচাতে গিয়ে এত কিছু, সেই বৃদ্ধ নিজে কেমন যেন থম মেরে গিয়েছেন। বেঁচে পাড়ে ফেরার পরে তাঁকে যখন গ্রামের কয়েক জন রিকশায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন তখনও তিনি বিড়বিড় করছেন, ''আমি মরলাম না, ছেলেটা মরে গেল, ছোট ছেলেটা মরে গেল গো!'' প্রত্যক্ষদর্শী মাঝি ও যাত্রীদের দাবি, আত্মহত্যা করতে চটি খুলে রেখে বৃদ্ধ জলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলেছেন, ''ঝাঁপ দিইনি তো, মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। জলে পড়ে গেলাম।''

কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাস দাসপাড়ায় বাড়ি সুব্রতদের। তাঁরা দুই ভাই। মাধ্যমিকের পরে স্কুল ছেড়ে পরিবারের জমিজমা দেখাশোনা করতেন তিনি। সুনাম ছিল পাড়ায়। এলাকার বাসিন্দারাই জানালেন, কোথাও কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, রাত জাগতে হবে বা শ্মশানে যেতে হবে— সব জায়গায় সুব্রত এগিয়ে যেতেন।

ছুটির দিন কৃষ্ণগঞ্জ বাজারে মাংস-রুটি খেতে যাবেন বলে নৌকায় উঠেছিলেন সুব্রত। সেখানে অন্য যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন তেঁতুল ঘোষও। মাঝিমাল্লারা জানিয়েছেন, বৃদ্ধ প্রায়ই লাঠিতে ভর করে একা নৌকায় যাতায়াত করতেন। এ দিন তিনি আচমকা জলে পড়ে যাওয়ার পরে সুব্রত যখন তাঁকে বাঁচাবেন বলে উঠে দাঁড়িয়েছেন তখন অনেকেই তাঁকে বারণ করেছিলেন। ভরা নদী এবং প্রচুর কচুরিপানায় বিপদ ঘটতে পারে বলে সতর্কও করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের কথায়, ''ছেলেটা বলল, চোখের সামনে একটা লোক ডুবে মরবে এটা সে দেখতে পারবে না। বলেই সে লাফ মারল জলে।''
সেই সময় পাড়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল সুব্রতর ভাই বছর ষোলোর সুমন। দাদাকে ঝাঁপাতে দেখে সে-ও জলে ঝাঁপায়। সাঁতরে দাদার কাছে চলে যায়। তত ক্ষণে বৃদ্ধকে টেনে তুলেছেন সুব্রত। ভাইয়ের হাতে তাঁকে ছেড়ে দিয়ে পাড়ে নিয়ে যেতে বলেন। সুমন বৃদ্ধকে টানতে-টানতে পাড়ে নিয়ে আসে। কিন্তু সুব্রত সম্ভবত ধকলে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর শরীরে আর সাঁতার কাটার মতো দম ছিল না। সকলের চোখের সামনেই তিনি তলিয়ে যান!
সুমনের আক্ষেপ, "দুই পাড়ে অত লোক ছিল, নৌকাতেও লোক ছিল। কেউই সাহস করে দাদাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না! আমার শরীরেও তখন এতটুকু জোর ছিল না যে, দাদাকে বাঁচাতে যাব।''