ডায়াবিটিস থেকে চোখ, ভালো গবেষণা শহরেই


দাঁতের গোড়ায় কি লুকিয়ে থাকে ডায়াবিটিসের পূর্বাভাস? মাড়ি দেখে কি আগাম বোঝা সম্ভব, ডায়াবিটিস থাবা বসাতে পারে ভবিষ্যতে? বিশেষ একটি মাড়ির রোগ নিয়ে গবেষণা করতে করতে এই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে শহরেরই একটি সরকারি হাসপাতালে। 
এসএসকেএমের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের একদল গবেষক বিজ্ঞাননির্ভর কিছু তথ্যের উপর ভিত্তি করেই আন্দাজ করছেন, আগামী দিনে ডায়াবিটিসের শিকড় বর্তমানে লুকিয়ে থাকতে পারে মামুলি পেরিওডন্টাইটিস (মাড়ির এক রকম প্রদাহ) নামের অসুখে। প্রকল্পের মুখ্য গবেষক, এন্ডোক্রিনোলজির শিক্ষক-চিকিৎসক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, 'রোগাক্রান্ত মাড়ি থেকে সংগৃহীত মাইক্রো-আরএনএ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পেরিওডন্টাইটিস হলে শরীরে এমন কিছু রাসায়নিকের সংশ্লেষ হয় যা ইনসুলিন ক্ষরণে বিঘ্ন ঘটায় ভবিষ্যতে।' 

অবশ্য শুধু মাড়ির রোগ নিয়েই নয়, ডায়াবিটিস সম্পর্কিত গুচ্ছ গবেষণা চলছে এসএসকেএমে। এবং তাকে সাধুবাদ জানাচ্ছে চিকিৎসক মহল। কেননা, বর্তমানে ডায়াবিটিসের মিষ্টি ছোবলের গ্রাসে সমাজের একটা বড় অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবও বলছে, এ দেশই সারা দুনিয়ায় ডায়াবিটিসের রাজধানী। আগামী দিনের ভ্রূকূটি পরের কথা। এখনই ঘরে ঘরে শর্করার মাত্রা ঢের বেশি রক্তে। ফলে এ রোগের প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসায় সহায়ক গবেষণা জরুরি। আশার কথা, বসে নেই কলকাতা। 

যেমন ডায়াবিটিক ফুট আলসার। রক্তে দীর্ঘ দিনের অনিয়ন্ত্রিত শর্করা থেকে স্নায়বিক বৈকল্য থেকেই এ রোগের সূত্রপাত। সাড় থাকে না বলে পায়ের ছোটখাটো ক্ষত বুঝেই উঠতে পারে না রোগী। আবার ডায়াবিটিসের কারণেই সে ক্ষত সারার বদলে ক্রমাগাত আরও খারাপ দিকে যায়। পরিসংখ্যান বলছে, আমজনতার প্রায় ৪% এবং ডায়াবিটিকদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব প্রায় সিকিভাগ। অথচ দেশের এ তল্লাটে এই অসুখ নিয়ে গবেষণার বড় অভাব। 

ব্যতিক্রমী অবশ্য এসএসকেএম। রাজ্য জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের অনুদানে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ডায়াবিটিক ফুট আলসারের (ডিএফইউ) চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা চলছে এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগে। এসএসকেএমের এন্ডোক্রিনোলজি বিশেষজ্ঞ সতীনাথ বলেন, 'পায়ের আলসারের উপর একটা বায়ো-ফিল্ম তৈরি হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে। তখন আর অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। ফলে দাপট অব্যাহত থাকে ব্যাকটেরিয়ার। ওই বায়ো-ফিল্মের জিন সিকোয়েন্সিং করে বোঝার চেষ্টা করছি, তার মধ্যে ১৬-এস-আরএনএ আছে কিনা। যদি থাকে, তখন বুঝতে হবে, সংক্রমণটা ঘাঁটি গেড়েছে বেয়াড়া ভাবে। বায়ো-ফিল্মের বাধা টপকে ওই জীবাণুকে কী ভাবে ঘায়েল করা যায়, আমরা সেই চেষ্টাটাই করছি।' 

ন্যাশনাল টি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অর্থানুকুল্যে এই প্রতিষ্ঠানেই চলছে আরও একটি অভিনব গবেষণা যা প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। গবেষকরা জানাচ্ছেন, চালু বিশ্বাস হল, গ্রিন টি-তে নিয়ন্ত্রণে থাকে ডায়াবিটিস। কেননা, গ্রিন টি-তে থাকে বায়োফেনল। কিন্তু গবেষণায় তাঁরা দেখছেন, সাধারণ ব্ল্যাক টি-তেও থাকে বায়োফেনল। ফলে দিনে চার কাপ ব্ল্যাক টি খেয়েও শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব কিনা, এবং সম্ভব হলে তা কতটা কার্যকর, সেটাই গবেষণার মূল বিষয়। 

যদিও যাবতীয় গবেষণার ক্ষেত্রে আর্থিক অনুদান সংক্রান্ত প্রশাসনিক জটিলতায় বিরক্ত গবেষকরা। এক অধ্যাপকের কথায়, 'সর্বত্রই অনুদান বরাবর সরাসরি প্রকল্পের অ্যাকাউন্টে আসে। কিন্তু সম্প্রতি এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ ফতোয়া দিয়েছেন, সব অনুদান জমা হবে অধিকর্তার অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে আসবে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের অ্যাকাউন্টে। এমনিতেই আমাদের গবেষণার পাশাপাশি ক্লার্কের কাজও করতে হয়। নয়া নিয়মে সে কাজের চাপটা আরও বেড়েই যায়নি। প্রভূত দেরি ও জটিলতাও তৈরি হচ্ছে গবেষণার টাকার জন্য।' 

প্রশাসনিক সমস্যায় শিকেয় উঠেছে আরও একটি অভিনব গবেষণা। তবে এসএসকেএমে নয়, আর এক ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠান রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজিতে (আরআইও)। সমস্যার নাম, বদলি। গবেষণাটি ছিল কর্নিয়ার চিকিৎসায় স্টেম সেল গ্রাফটিং। গবেষণা প্রকল্পের এক সদস্য বলেন, 'কনজাংটিভার কিছু টিস্যু অনেক সময়ে কর্নিয়ার উপর জমা হয়। একে টেরিজিয়াম বলে। এর চিকিৎসায় স্টেম সেল গ্রাফটিং নিয়েই কাজ চলছিল। প্রসূতির নাড়ি থেকে সংগৃহীত রক্ত থেকে স্টেম সেল নিয়ে কাজটা করতাম। ভালো ফলও মিলতে শুরু করেছিল। কিন্তু একজন সিনিয়র সদস্যকে মেদিনীপুর বদলি করে দিল স্বাস্থ্য দপ্তর। থমকে গেল গবেষণা।'