বাড়ির লোক ভেবেছিল আমিও ভেসে গিয়েছি


সরোজ মণ্ডল (আলেপ্পিতে কর্মরত জলঙ্গির বাসিন্দা) 

ওই কয়েকটা ঘণ্টা সারা জীবনেও ভুলব না। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি চলছিলই। আমার বাড়ি জলঙ্গির শাদি খাড়দিয়ার অঞ্চলে। ছোট থেকেই বন্যা ও ভাঙন দেখে অভ্যস্ত। এবার আলেপ্পিতে বর্ষার বহর দেখে আমরা বলাবলি করছিলাম, বন্যা না হয় এবার। আশঙ্কাই সত্যি হল। সারা রাত প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। তবু কেমন একটা দম আটকানো ভাব ছিল। ভোররাতে ঘুম ভাঙল একটা 'গুড়গুড়' শব্দে।

ছাদে উঠেছিলাম দেখতে। কী হচ্ছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম লাল জলের স্রোত। কয়েকটা মাত্র মুহূর্ত ... আমাদের পাড়াটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জলের নীচে চলে গেল। জলের ধাক্কায় বাড়িটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আমরা কয়েক জন প্রাণ বাঁচাতে ছাদে উঠেছিলাম। আর নামতে পারিনি। টানা বৃষ্টিতে ছাদেই বসে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা শুরু করলাম যে যার মতো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন জলে ভিজে বন্ধ হয়ে গেল। এবার আমরা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। ঠান্ডা মাথায় প্রাণরক্ষার পরিকল্পনা শুরু করলাম সবাই মিলে। প্রথমে বাড়িতে যেটুকু খাবার জমানো ছিল সেগুলো উপরে আনার ব্যবস্থা করা করল। এর পর ফোন শুকোনোর পালা। বুঝেছিলাম, ফোন চালু থাকলে তবু কারও কাছে নিজেদের খবর দেওয়া যাবে। 
যেটুকু খাবার সঞ্চয়ে ছিল, সেটা অল্প অল্প করে খেয়ে দু'দিন চালাতে পেরেছিলাম। এরপর খাবার আর পানীয় জল দুই-ই শেষ হয়ে গেল। লাল জলের সমুদ্রে আমাদের বাড়িটা ছোট একটা দ্বীপের মতো জেগে ছিল। বাড়ির ছাদে না খেয়ে দু'দিন বসেছিলাম আমরা। বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। ফোনের ব্যাটারির চার্জ ক্রমশ কমতে কমতে একসময় শেষ হয়ে গেল। যতক্ষণ ফোন চালু ছিল, ততক্ষণ বাড়িতে জানাতে পারছিলাম 'বেঁচে আছি।' আর সেই উপায়ও রইল না। 

এক সময় মনে হচ্ছিল জলে ডুবেই মরাই আমাদের নিয়তি। আরও কতক্ষণ এই ভাবে কেটেছিল জানি না। হঠাৎ গলার আওয়াজ পেয়ে দেখি আলসে দিয়ে ছাদে উঠছেন তিন জন সেনা জওয়ান। হাত তুলে আশ্বাস দিলেন ওঁরা। একজন হিন্দিতে বললেন, 'ডরো মত, হম আ গয়ে।'

ওঁরাই আমাদের ছ'জনকে বের করে নিয়ে গেলেন একটা ত্রাণ শিবিরে। শিবিরে পৌঁছে প্রথম আর এক শরণার্থীর ফোন থেকে বাড়িতে যোগাযোগ করলাম। তিন দিন কোনও খবর না পেয়ে মা ধরেই নিয়েছিল আমি ভেসে গিয়েছি। অচেনা নম্বর থেকে ফোন পেয়ে দুরু দুরু বুকে ফোন তুলেছিল। খারাপ খবর পাবে ধরেই নিয়েছিল। আমার গলা শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। বাড়ির সবাই একবার করে কথা বলে নিশ্চিন্ত হল, সত্যিই আমি বেঁচে আছি। ত্রাণ শিবির থেকে দু'দিন পর এর্নাকুলাম এলাম। শুকনো মাটিতে হাঁটতে পেরে বড্ড ভালো লাগল। শনিবার ট্রেনে উঠেছি। সোমবার হাওড়া নামব। আগে বাড়ি গিয়ে মা'র সামনে দাঁড়াব। এখন একটাই সমস্যা, ফোনটা ঠিকমতো কাজ করছে না।