নোটবন্দিই কেড়ে নিল ওঁকে, স্মৃতিকাতর স্ত্রী


কেটে গিয়েছে প্রায় দু'বছর। কিন্তু পিছনের দিকে তাকালে এখনও তাঁর মনে হয়, এই তো সে দিনের ঘটনা। ফোনে উৎকণ্ঠা ভরা গলায় স্বামী জানালেন, নোটবন্দির জন্য কোচবিহারের কোনও ব্যাঙ্ক বা এটিএমে টাকা মিলছে না। এ দিকে, হাতেও পয়সাকড়ি প্রায় নিঃশেষিত। অনেক ধার-দেনা হয়ে যাচ্ছে। আর কোনও উপায় না দেখে কলকাতায় আসছেন এটিএম থেকে টাকা তুলতে।

কোচবিহার থেকে কলকাতায় আর আসতে পারেননি সীমা রায়চৌধুরীর স্বামী কল্লোল রায়চৌধুরী। আসার পথে ব্যান্ডেল স্টেশনে একটি এটিএমে লাইন দিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। 

সম্প্রতি ফের চর্চা শুরু হয়েছে নোটবন্দি নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সে সময়ে বলেছিলেন, কালো টাকা উদ্ধার করতেই ওই পদক্ষেপ। তার পরে প্রায় দু'বছর কেটেছে। কতটা কালো টাকা উদ্ধার হল? অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, যে পরিমাণ টাকা নোটবন্দি করা হয়েছিল, সেই টাকা আবার বাজারে ফিরে এসেছে। এর ফলে নোটবন্দিতে কতটা কালো টাকা উদ্ধার হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদেরা। যা শুনে সীমাদেবী বলছেন, ''আমি রাজনীতি বা অর্থনীতি বুঝি না। তবে এটুকু বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রী মোদীর নোটবন্দির জেরেই আমি আমার স্বামীকে হারালাম। আমার দশ বছরের ছেলে শুভদীপ ওর বাবাকে হারাল।''

সীমাদেবী স্বামীর মৃত্যুর পরে তাঁর চাকরি পেয়েছেন রাজ্য সরকারের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগে। কলকাতাতেই অফিস। ছেলে শুভদীপকে নিয়ে থাকেন বেহালার আদর্শ নগরে। শুভদীপ এখন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে থেকে পড়াশোনা করে। সীমাদেবী বলেন, ''প্রধানমন্ত্রীর নোটবন্দির সিদ্ধান্তে গত দু'বছরে কার কী উপকার হয়েছে বলতে পারেন? আমার মতো সাধারণ মানুষ তো সাদা চোখে কোনও লাভ দেখতে পাচ্ছি না।''

সে দিনের ঘটনার কথা বলতে গিয়ে এখনও গলা ভারী হয়ে আসে সীমাদেবীর। তিনি জানান, চাকরি সূত্রেই তাঁর স্বামী কোচবিহারে থাকতেন। নোটবন্দির সময়ে কোচবিহারের অবস্থা যে খুব খারাপ ছিল, ফোনে বারবারই তা জানিয়েছিলেন স্ত্রীকে। সীমাদেবী জানান, কোচবিহারের এটিএম থেকে কোনও টাকা মিলছিল না। দু'দফায় শুধু ব্যাঙ্ক থেকে ১০ টাকার কয়েনে ২০০ টাকা ও ৫০০ টাকা তুলতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামী। সেই টাকা কিছু দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। হাতে টাকা না থাকায় দোকানপাট ও বাজারে প্রচুর দেনা হয়ে যায়। সীমাদেবী বলেন, ''কার্যত কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন আমার স্বামী। কলকাতায় এসে এটিএম থেকে টাকা তুলবেন বলে ২ ডিসেম্বর কোচবিহার থেকে ট্রেনে রওনা দেন।'' 

৫২ বছরের কল্লোলবাবু যে ট্রেনে উঠেছিলেন, সেটি হাওড়ায় আসছিল। কিন্তু শিয়ালদহে কিছু কাজ থাকায় তিনি শিয়ালদহ যাওয়ার জন্য ব্যান্ডেল স্টেশনে নামেন। ব্যান্ডেলে শিয়ালদহের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেই সময়ে দেখেন, স্টেশনের খুব কাছেই রয়েছে একটি এটিএম। সেই এটিএমে কল্লোলবাবু চলে যান টাকা তুলতে। ওই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই তিনি অসুস্থ হয়ে বসে পড়েন। স্থানীয়েরা কল্লোলবাবুকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। হাসপাতাল থেকেই সীমাদেবীর বাড়িতে খবর যায়।

নোটবন্দি নিয়ে চর্চা ফিরে এলেই স্বামীর কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে সীমাদেবীর। বললেন, ''প্রধানমন্ত্রীর একটা হঠকারি সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনকে শূন্য করে দিয়ে চলে গেল।''