এ কাহিনি আতঙ্ক ও গৃহচ্যুতির, ৭১ বছর পেরোলেও দেশভাগের দিনগুলো ভোলেননি সুরজিৎ

বয়স ৮০ ছাড়িয়েছে। কিন্তু নয়াদিল্লির বাড়িতে বসে এখনও চোখ বুজলেই ওয়াজিরাবাদের রাস্তা দেখতে পান সুরজিত কুমারী। বিড়বিড় করে বলে যান, 'স্টেশনে নেমে প্রথমে বাঁদিক, তারপর ডানদিকে ঘুরে সোজা হাঁটতে থাকবে, যতক্ষণ না...'। রেল স্টেশন থেকে 'নিজের বাড়ি'-র রাস্তাটা এখনও স্পষ্ট দেখতে পান তিনি। স্বাধীনতা দিবস আসে আর তাঁর মনে পড়ে যায় দেশভাগের সেই দিনগুলোর কথা।

১৯৪৭ সালে তখন তাঁর বয়স খুবই কম। বর্তমান পাক পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে ছিল তাঁদের তিনতলা বিশাল বাড়ি। বাবা বসন্ত রাম ছিলেন এলাকার সম্ভ্রান্ত ব্যবসাদার। কাঠের ব্যবসা ছিল তাঁর। সুরজিত জানিয়েছেন ধর্মীয় বাধা ছিল অনেক, তাও হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার পথ খুঁজে নিয়েছিল। হিন্দুরা মুসলমানদের বাড়িতে, বা মুসলমানদের হাতে তৈরি খাওয়ার খেত না। মুসলমানরাও তাকে সম্মান করত। উৎসবে পার্বণে মিষ্টি বিনিময় কিন্তু ছিল। হিন্দু কারিগরের তৈরি মিষ্টি উপহার দিতেন মুসলমানরা। আবার বসন্ত রামের কাঠের আসবাব সব তৈরি করত মুসলমান ছুতোররাই।

সুরজিত কুমারী জানিয়েছেন দেশভাগের একটা গুজব অনেকদিন ধরেই ছিল। একসময় যে জন্য তাঁরা ওয়াজিরাবাদ ছেড়ে জম্মুতে এসে ছিলেন কয়েকদিন। কিন্তু তারপর আবার সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যায়, তাঁরাও বাড়ি ফিরে যান। এর কয়েকমাস বাদে যখন সত্যি সত্যি দেশভাগ হয়, তখন ভাগ্যক্রমে এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে সুরজিতরা ছিলেন হিমাচল প্রদেশে। কিন্তু দাঙ্গার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াজিরাবাদে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা বসন্ত রাম।

বাবার কাছে সুরজিত শুনেছিলেন স্থানীয় মুসলিমরা না রক্ষা করলে তাঁর পক্ষে বাঁচা সম্ভব হত না। ওয়াজিরাবাদে পৌঁছে বসন্তরাম দেখেছিলেন সেখানে আগুন জ্বলছে। নির্বিচারে চলছে খুন, অগ্নিসংযোগ। মহিলারা পিঠে সন্তানকে বেঁধে নিয়ে যেদিকে পারছেন ছুটছেন। তাঁর এক ঘনিষ্ট বন্দুকে তাঁর চোখের সামনেই কুপিয়ে হত্যা করেছিল দাঙ্গাবাজরা। তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন তাঁদের মুসলিম দুধওয়ালা।

সেই দুধওয়ালা মুসলিম বসন্তকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। তাঁকে বলেছিলেন স্থানীয়রা কেউ বসন্তের ক্ষতি করবে না, তাঁর কোনও শত্রুও নেই। কিন্তু তাও বসন্তের চলে যাওয়াই উচিত। বসন্ত রামের জন্য তিনি গাড়িরও ব্যবস্থা করে দেন। সেই গাড়িতে রাধুনী ও একজন বন্দুকধারীকে নিয়ে, সামান্য কিছু জিনিস নিয়েই হিমাচলে ফেরার পথ ধরেছিলেন সুরজিত কুমারীর বাবা।

একই পথের যাত্রী ছিলেন তাঁর কয়েকজন বন্ধু তথা স্থানীয় হিন্দুও। বসন্ত রাম তাঁদের বলেছিলেন ঝিলামের রাস্তা ধরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম রাস্তার যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা লাহোর দিয়ে যাওয়ার কথা ঠইক করেন। তাঁদের কেউ হিমাচল প্রদেশে পৌঁছতে পারেননি। বসন্ত. ঝিলাম রুট দিয়ে বাড়ি পৌঁছান।

তবে মৃত্যুর খুব কাছে এসেছিলেন তিনিও। সদ্য ঠিক হওয়া সীমান্তে এক মুসলিম পুলিশ তাঁদের মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই পুলিশ ছিল হিমাচলী। বসন্ত তাঁকে বলেছিলেন একই গ্রামের লোককে কিভাবে কেউ হত্যা করতে পারে? তাতেই কাজ হয়েছিল। পুলিশটি জানিয়েছিলেন হিমাচলে আটকে আছে তাঁর পরিবার।

এদিকে হিমাচলের বাড়িতে সবাই ধরেই নিয়েছিলেন বসন্ত রামের মৃত্যু হয়েছে। সুরজিত কুমারী জানিয়েছেন তাঁদের হিমাচলের বাড়িতে একরাতে ডাকাত পড়ার খবর ছিল। তিনি আর তাঁর কাকা বন্দুক হাতে ছাদে বসেছিলেন ডাকাতদের অপেক্ষায়। সেই রাতে ডাকাত আসেনি, এসেছিলেন তাঁর বাবা। সারা পায়ে ফোস্কা পড়ে, কারণ সীমান্ত পার হওয়ার পর থেকে বাকি রাস্তাটা তাঁকে হেঁটেই আসতে হয়েছিল।

তাঁরা হিমাচল প্রদেশে চলে আসার পরও কিন্তু ওয়াজিরাবাদের মুসলিম প্রতিবেশীরা তাঁদের ভোলেননি বলে জানিয়েছেন বৃদ্ধা সুরজিত কুমারী। তাঁদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল কিছু দাঙ্গাবাজ। স্থানীয় মুসলিমরাই রাতভর জল ঢেলে সেই আগুন নিভিয়েছিলেন। আর তারপর তাঁদের যাবতীয় আসবাব পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের হিমাচলপ্রদেশের বাড়িতে। অবিভক্ত ভারতে মুসলিম কারিগরদের তৈরি সেই আসবাব এখনও তাঁদের দিল্লির বাড়িতে রয়েছে।

জীবনের সায়াহ্নে এসে এখন সুরজিতের বড় সাধ হয় ১১ বছর বয়সে ছেড়ে আসা সেই বাড়িটার সামনে আরও একবার গিয়ে দাঁড়াতে। নাতি নাতনীদের বলেন, 'একবার আমাকে ওয়াজিরাবাদের স্টেশনে নামিয়ে দিলেই হবে। বাকিটা আমি একাই চলে যেতে পারব। প্রথমে বাঁদিকে ঘুরতে হবে, তারপর ডানদিক। তারপর সোজা হাঁটা, যতক্ষণ না...।'