দিল্লির দূষণে শরীরে ক্ষতি কতটা, পরীক্ষা কলকাতায়


বাতাসে ভর্তি ধুলো-ধোঁয়ার বিষ। সেই বিষ বাড়িয়ে দেয়, এমন কার্যকলাপ ক্রমশই বাড়ছে। এই অবস্থায় রাজধানী দিল্লি তথা তাকে ঘিরে থাকা গোটা এনসিআরের (ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন) বাসিন্দাদের পরিষ্কার ও টাটকা-তাজা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্বপ্ন সুদূর পরাহত বলেই মনে করছে সংসদের পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটি।

দিল্লিতে বায়ু দূষণের বিপজ্জনক চিত্র ও তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট ওই কমিটি গত ৭ অগস্ট সংসদে পেশ করেছে। দিল্লিতে ২০১৩ থেকে ২০১৭-এই পাঁচ বছরে ৯৮১ জন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মারা গিয়েছেন। এমনটাই সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রিপোর্টে জানিয়েছে। কমিটির তৈরি ৪১ পাতার ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, দেশের অন্যান্য জায়গার বাসিন্দাদের তুলনায় দিল্লির মানুষ শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির মতো রোগে অনেক বেশি ভোগেন। যে পরীক্ষার মাধ্যমে কমিটি ওই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, সেই পরীক্ষা করেছে কলকাতার হাজরা মোড়ের চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ওই পরীক্ষা করিয়েছে।

কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, দিল্লির বায়ু দূষণ বড়দের ও ছোটদের শরীরের কতটা ও কী রকম ক্ষতি করছে, আলাদা ভাবে সেই পরীক্ষা হয়েছে কলকাতার ওই হাসপাতালে। সেখানে দিল্লিতে বসবাস করা একদল মানুষ ও অন্যান্য এলাকার বাসিন্দা একদল মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। বড়দের উপর ওই পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে, দিল্লির বাসিন্দাদের মধ্যে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্য এলাকার মানুষের চেয়ে ১.৭ গুণ বেশি। যেখানে অন্য জায়গার মানুষদের ৩.৯ শতাংশ হাঁপানিতে ভোগেন, দিল্লির মানুষদের ৭.৬ শতাংশ ভুগছেন ওই রোগে। ফুসফুসের কাজ করার ক্ষমতাও অন্য এলাকার মানুষদের বেশি, তাঁদের তুলনায় দিল্লির নাগরিকদের অনেকটাই কম। 

বায়ু দূষণ দিল্লির শিশুদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। পরীক্ষায় ধরা পড়েছে, শিশুদের এক-তৃতীয়াংশই ভুগছে শ্বাসকষ্টে। অন্য এলাকার শিশুদের ১৮.২ শতাংশের মধ্যে ওই সমস্যা। কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মার সমস্যা রয়েছে দিল্লির ৭ শতাংশ শিশুর। দেশের অন্য প্রান্তে থাকা শিশুদের ৩.৮ শতাংশ শিশুর ওই সমস্যা। আবার হুইজ বা শ্বাস নেওয়ার সময়ে বুকে বাঁশির মতো শব্দ হয় দিল্লির ৪.৮ শতাংশ শিশুর। অন্য জায়গার শিশুদের ২.৭ শতাংশ শ্বাসের ওই সমস্যায় ভুগছে। আবার দিল্লিতে বসবাস করা ৪৩ শতাংশ শিশুর ফুসফুসের ক্ষমতা কম। তবে দেশের অন্য জায়গার শিশুদের ২৫.৭ শতাংশের মধ্যে ওই সমস্যার কথা পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। 

কমিটি তার রিপোর্টে বাজি পোড়ানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, প্রতি বছর দেওয়ালির সময়ে সস্তার আতসবাজি পোড়ানো হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওই সব বাজি তৈরি করা হয় বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে। ওই বাজি পোড়ানোর ফলে দিল্লি 'গ্যাস চেম্বারে' পরিণত হয়। কমিটির বক্তব্য, বাজির দূষণ নিয়ন্ত্রণে আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন। কমিটির মত হল, কেন্দ্রীয় সরকার অন্য রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে আলোচনা করে এমন একটি ব্যবস্থা চালু করুক, যাতে শুধু এমন আতসবাজি তৈরি হবে, যেগুলি কম বায়ুদূষণ ঘটায়। কমিটির সুপারিশ, পরিবেশ ও মানব দেহে ক্ষতিকর প্রভাব রুখতে বাজিতে কী ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হবে, সেই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার কঠোর নির্দেশিকা জারি করার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করতে পারে। 

তবে কম দূষণ ঘটাবে, এমন বাজি তৈরি এক রকম সোনার পাথরবাটি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের কথায়, 'বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত যত এগিয়েছে, তাতে দূষণ ছড়াবে না, এমন বাজির কথা আমাদের জানা নেই।' রাজ্যের পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, বাতাসে কম বিষ ছড়াবে, এমন বাজি তৈরি করতে যে রাসায়নিক দরকার, তার দাম সোরা, গন্ধক, কাঠকয়লা, লোহাচুরের মতো আতসবাজির সাধারণ উপকরণের চেয়ে অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে বাজির দাম হবে আকাশছোঁয়া। তবে পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক, বর্তমানে পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, 'প্রয়োজনে সেটাই হবে। পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার সঙ্গে কোনও ভাবে সমঝোতা করা যায় না।'