দাবিটা ন্যায্য, বুঝিয়ে দিল হাইকোর্ট


বাম জমানায় পাওনা-গন্ডা থেকে বঞ্চিত হতে হয়নি রাজ্য সরকারি কর্মীদের সে ভাবে। সরকারি কর্মীরা সে যুগে এমন একটি শ্রেণি হিসেবে মোটের উপর পরিচিত ছিলেন, যে শ্রেণির উপরে শাসকদল ভরসা করতে পারত। শব্দচয়নে রাশ একটু আলগা করে কথ্য প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে বলা যায়, সরকারি কর্মীরা সে সময় বামেদের ভোটব্যাঙ্ক ছিলেন। তাই বাম সরকার আগাগোড়া খেয়াল রেখেছিল সরকারি কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে।

বর্তমান জমানা আবার অন্য রকম। জনসংখ্যার মাত্র কয়েক শতাংশ হিসেবেই সম্ভবত সরকারি কর্মীদের দেখছে এখনকার শাসকদল। বামেদের ভোট রাজনীতির চেয়ে তৃণমূলের ভোট রাজনীতির ধাঁচটাও আলাদা। তাই বামেরা যে ভাবে সরকারি কর্মীদের 'ভোট মেশিনারি' হিসেবে দেখছেন, তৃণমূল নেতৃত্ব সে ভাবে দেখেন না। ভোট কর্মীদেরকে 'ভোট মেশিনারি'-তে পরিণত করার প্রয়োজন নেই, ভোটের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে আরও অনেক বেশি বেপরোয়া বাহিনীকে রাস্তায় নামানোর ক্ষমতা তৃণমূলের রয়েছে— জানেন দলের নেতারা। তাই সরকারি কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্যের খামতি নিয়ে এই সরকার খুব বেশি ভাবিত নয়। পথে-ঘাটে চলতে গিয়ে চোখে পড়বে এমন নানা প্রকল্পে খরচ করা এই সরকারের কাছে অধিকতর পছন্দের। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, যুবশ্রী বা কৃষিরত্ন, শিক্ষারত্ন বা সবুজসাথী, পথেরসাথী বা মেলা-খেলা-উৎসব— এই ধরনের খাতে বা অ-খাতে খরচ করা এই সরকারের কাছে অধিকতর পছন্দের।

দুই দৃষ্টিভঙ্গিই আপত্তিকর। সরকারি কর্মীদের বিশেষভাবে কাজে লাগানো যাবে বলে তাঁদের খুশি রাখা অথবা অন্যতর ভোটব্যাঙ্ক এবং ভিন্নতর ভোট মেশিনারি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বলে সরকারি কর্মীদের অবহেলা করা— এই দুটির কোনওটিই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে বাম আমলে অন্য সকলকে বঞ্চিত করে সরকারি কর্মীদের পাওনা-গন্ডা মেটানো হচ্ছিল, এমনটা নয়। এ জমানায় বরং বঞ্চনার অভিযোগটা উঠছে। নজরকাড়া খাতে বা ভোট টানার খাতে অতিরিক্ত খরচের জোগান নিশ্চিত করতে গিয়ে সরকারি কর্মীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে।

মহার্ঘভাতা সরকারি কর্মীদের ন্যায্য প্রাপ্য। কারণ তা আইনসিদ্ধ অধিকার। জানিয়ে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। ন্যায্য মহার্ঘভাতা থেকে বঞ্চিত হয়ে রাজ্য প্রশাসনের ট্রাইব্যুনালে দ্বারস্থ হয়েছিল কর্মী সংগঠনগুলি। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে রাজ্য সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, মহার্ঘভাতা পাওয়া কর্মীদের অধিকার নয়, মহার্ঘভাতা সরকারের ইচ্ছা নির্ভর, কারণ তা 'দয়ার দান'। ট্রাইব্যুনাল ওই তত্ত্বেই সিলমোহর দিয়েছিল। সরকারি কর্মীদের জন্য অত্যন্ত জোরালো ধাক্কা ছিল ট্রাইব্যুনালের ওই রায়।

প্রথমত, মহার্ঘভাতা প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থানটাই বিস্ময়কর ঠেকেছিল সরকারি কর্মীদের কাছে। দ্বিতীয়ত, সেই তত্ত্বে সিলমোহর পড়ে গিয়েছিল ট্রাইব্যুনালের তরফ থেকে। কর্মীরা হতাশ ছিলেন, নিরাশ ছিলেন, ছিলেন ভগ্নমনোরথ। কলকাতা হাইকোর্টের রায় কিন্তু রাজ্য সরকারি কর্মীদের মনোবল বাড়িয়ে দিল। মহার্ঘভাতা পাওয়া কর্মীদের আইনসিদ্ধ অধিকার, এ কথা হাইকোর্ট বলে দেওয়ায় সরকারি কর্মীরা নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের লড়াইয়ে আরও উৎসাহ পেলেন। আশার আলো নিয়ে পরবর্তী ধাপের লড়াইয়ে সামিল হওয়ার রসদ পেলেন।

কর্মীরা কী হারে মহার্ঘভাতা পাবেন, কিসের ভিত্তিতে মহার্ঘভাতার হার নির্ধারিত হবে, বছরের কোন সময়ে মহার্ঘভাতা ঘোষিত হবে— এ সব বিষয়ে কোনও নির্দেশ হাইকোর্ট দেয়নি। রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালেই ফিরে যেতে বলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালই ওইসব প্রশ্নের জবাব দেবে— এমনই হাইকোর্টের তরফ থেকে বলা হয়েছে। অর্থাৎ আরও একটা লড়াই সামনে মহার্ঘভাতা আদায়ের জন্য। যে ট্রাইব্যুনাল বলেছিল মহার্ঘভাতা অধিকার নয়, লড়াই আবার সেই ট্রাইব্যুনালেই। এই লড়াইয়ের জন্য মনোবলটা আরও বেশি দরকার হবে সম্ভবত। হাইকোর্টের স্বীকৃতি বোধহয় সেই মনোবলটা জুগিয়ে দিল।  অধিকার যখন আইনসিদ্ধ, তখন আদায় তো হবেই— হাইকোর্ট এই বিশ্বাসটা চারিয়ে দিল।