‌৭২ বছরেও বিনা পয়সায় ছাত্র পড়াতে দূরের গ্রামে ছোটেন অবোধ দফাদার


বসিরহাট: সেই কবে, যেদিন গ্রামের স্কুলে প্রথম শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন, সেদিন বাবা বলেছিলেন, '‌স্কুলে ছাত্র পড়াতে যাচ্ছ। সরকার বেতন দেবে। জীবনে কোনও দিন যেন টাকা নিয়ে প্রাইভেট পড়াবে না। তুমি যে–টুকু জানো, তা–ই ছেলেমেয়েদের শেখাবে।'‌ নিতান্ত কৃষিজীবী বাবার কথা আজও মনে রেখেছেন অবোধকুমার দফাদার। ৭২ বছরে পা দেবেন অক্টোবরে। বছর তিনেক হল বুকে পেস মেকার বসেছে। এখনও তিনি '‌পিতৃসত্য'‌ পালনে কোনও বিষয়ে এতটুকু নড়চড় হতে দেননি।

প্রতিদিন অবোধবাবু ব্যাটারিচালিত স্কুটি চেপে বসিরহাটের সীমান্ত লাগোয়া ইটিন্ডা গ্রাম থেকে কোথায় রঘুনাথপুর, কঁাকড়া গ্রামে ছোটেন সাহিত্য পড়াতে। একবার পড়াতে বসে গেলে আর ওঠেন না। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছেলেমেয়েদের বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য পড়াতে পাঠের গভীরে ডুবে যান তিনি। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিও আছে অবোধবাবুর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। ছাত্র জীবন থেকে বাম রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ। ধুতি–পাঞ্জাবি পড়ে সকাল হতেই একটা স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ফেরেন পড়ানো শেষ করে। বিকেলে হঁাটতে বেরিয়ে চলতে চলতে এলাকার ছেলেমেয়েদের পাঠের ওপর আলোকপাত করেন। এ হেন অবোধবাবুর আরেকটা পরিচয় আছে সকলের কাছে। —'‌লজেন্স দাদু'‌। তিনি যখনই পথে বেরোবেন, তঁার সঙ্গে থাকে লজেন্স। যার সঙ্গেই দেখা হোক, পাঞ্জাবির পকেট থেকে লজেন্স বের করে তার হাতে দিয়ে কুশল বিনিময় করে নেন। এভাবেই তিনি সকলের কাছে '‌লজেন্স দাদু'‌ হয়ে গেছেন।
এদিন ইটিন্ডার বাড়িতে বসে অবোধ দফাদার বললেন, '‌আমার বাবা কানাইলাল দফাদার ছিলেন একেবারে দরিদ্র। অন্যের আশ্রয়ে তিনি কাটিয়েছেন। কৃষিকাজ করে আমাদের মানুষ করেছেন।'‌ তিনি বলেন, '‌১৯৬৭ সালে ৪ ডিসেম্বর পানিতর হাইস্কুলে যেদিন চাকরিতে যোগ দিই, সেদিন বাবা বলেছিলেন, কোনও দিন যেন প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা না নিই। আমি বাবার সেই কথা রাখতে আজও পড়িয়ে যাই।'‌ ছাত্রছাত্রীদের নাম কিংবা ফোন নম্বর অবোধবাবু মনে রাখেন না। তবে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখের গদ্য দু'‌চার পাতা মুখস্থ বলে যান অনায়াসে। ২০০৭–এ স্কুল থেকে অবসর নিয়ে আজও পড়াতে তার ক্লান্তি নেই।