ফের যেন অগ্নিপরীক্ষা, পুড়ে ছাই বাগড়ি বাজার, পুজোর আগে সর্বস্বান্ত বহু


ঠিক যেন এক দশক আগেকার 'অ্যাকশন রিপ্লে'! বড়বাজারে ফের নেমে এল অভিশপ্ত এক রবিবার। দশ বছর আগে পাঁচ দিন ধরে দমকলকে বেগ দিয়েছিল জ্বলন্ত নন্দরাম মার্কেট। এ বার তারই সামান্য দূরে ক্যানিং স্ট্রিটের বাগড়ি মার্কেট জুড়ে তাণ্ডব চালাল আগুন।

১৩তলা নন্দরামে তা-ও একেবারে উপরের তলাগুলি জ্বলেছিল। এ যাত্রা, ৭১ নম্বর ক্যানিং স্ট্রিটে ছ'টি ফটক, আটটি ব্লক-বিশিষ্ট প্রাসাদোপম ছ'তলা বাড়িটার আগাগোড়াই চলে গেল আগুনের গ্রাসে। ২৪ ঘণ্টা পরেও নেভেনি সেই আগুন। দমকলের ৩০টি ইঞ্জিনের টানা লড়াই সত্ত্বেও রবিবার প্রায় মধ্যরাতে দেখা যায়, জ্বলছে বাড়িটির ছ'তলা। একতলা-দোতলা-তেতলার কোণ থেকেও লাফিয়ে উঠছে আগুনের শিখা। দোতলা-চারতলায় নতুন করেও জ্বলে উঠছে আগুন। চার পাশে ধোঁয়াশা। ঘটনাস্থলে রয়েছেন ৩০০ দমকলকর্মী। প্রচণ্ড উত্তাপে বাগড়ি মার্কেটের দেওয়ালে ফাটল দেখা দেওয়ায় ৬৩ বছরের পুরনো বাড়িটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও করছেন অনেকে। দমকল জানিয়েছে, ক্রমাগত জল ঢেলে বাড়ির দেওয়াল ঠান্ডা রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।

দমকলের ডিজি জগমোহন সন্ধেয় বলেছিলেন, ''আগুন নিয়ন্ত্রণে।'' মার্কেটের ভিতর থেকে তখনও শোনা যাচ্ছিল সিলিন্ডার ফাটার মতো শব্দ। জিনিসপত্র বার করতে গিয়ে চার জন এবং উদ্ধারকাজে যাওয়া দু'জন দমকলকর্মী ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে লালবাজার সূত্রের খবর। অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে আজ, সোমবার দুপুর ২টোয় নবান্নে বৈঠক রয়েছে মন্ত্রিগোষ্ঠীর। থাকবেন দমকল, পুলিশ ও পুরসভার অধিকারিকেরাও।

দমকলের ডিজি জানিয়েছেন, আগুনের কারণ নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না। তবে পুলিশ ও দমকলের প্রাথমিক ধারণা, বাগড়ি মার্কেটের সামনে ফুটপাতময় হকারদের ডালা থেকেই ছড়িয়েছে আগুন। ক্যানিং স্ট্রিটেই ঘুমিয়ে ছিলেন স্থানীয় মোটবাহক অনিল মণ্ডল। তিনি বলেন, ''মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ছুটে গিয়ে দেখি, বাগড়ি মার্কেটের সামনে আগুন জ্বলছে।'' হোয়াটসঅ্যাপের একটি ভিডিয়োতেও দেখা যায়, আগুন জ্বলছে ফুটপাতে। স্থানীয়দের দাবি, দমকল আসার আগেই সেই আগুন ভিতরে ঢুকে পড়ে। রাজাকাটরার ব্যবসায়ী তাপস মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ''সুগন্ধির ক্যান-টিউবে ঠাসা হকারের ডালা থেকে আগুন ছড়িয়েই প্রথমে বিস্ফোরণ হতে শুরু করে। দু'দিকের ফুটপাতেই আগুন ছড়িয়েছিল।'' সকালে দেখা যায়, দু'দিকের ফুটপাতেই পড়ে রয়েছে কার্যত ধ্বংসস্তূপ।

উল্টো দিকে মেটা বিল্ডিংয়ের ফুটপাতের আগুন কিন্তু অন্য কোথাও ছড়ায়নি। তা নিভিয়ে ফেলেছিলেন স্থানীয় মোটবাহকেরা। বাগড়ি মার্কেটের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ মেলেনি। দমকল সূত্রের বক্তব্য,এখানে জ্বলন্ত ডালার সামনে ছিল একটি ল্যাম্পপোস্ট এবং বিদ্যুতের ফিডার বক্স। ল্যাম্পপোস্টে প্রচুর তার জড়ানো ছিল। সম্ভবত ওই তার বেয়েই আগুন ঢুকে পড়ে বাগড়ি মার্কেটে।

বাগড়ি মার্কেট মালিক কে

• বাগড়ি এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড। ডিরেক্টর—রাধা বাগড়ি এবং বরুণরাজ বাগড়ি (রয়েছেন একাধিক শেয়ার হোল্ডার)

দোকানদার ও ভাড়াটে

• আটটি ব্লকে দোকান, গুদামঘর, অফিস মিলিয়ে অন্তত ১৫০০ক্ষতির পরিমাণ

• ব্যবসায়ীদের দাবি, অন্তত ১০০ কোটি টাকা

কী কী রয়েছে

• ওষুধ, উপহার সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, সুগন্ধি, হার্ডওয়্যার, ইমিটেশন গয়না, বইখাতা, প্লাস্টিকের সরঞ্জাম, রাসায়নিক ল্যাবরেটরির সরঞ্জামের দোকান

• রয়েছে আইনজীবীর চেম্বার, পরিবহণ সংস্থার অফিস, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের ফার্ম

স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, আগুন লাগার পরে দমকলে ফোন করেও সাড়া মেলেনি। শেষে স্কুটি নিয়ে পোদ্দার কোর্টের কাছে দমকল কেন্দ্রে গিয়ে ডাকাডাকি করতে হয় তাদের। যদিও দমকলের বক্তব্য, রাত ২টো ৩৫ মিনিটে ফোন পাওয়ার পরেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিল তারা। গিয়ে দেখে, মার্কেটের বিভিন্ন দিকে আগুন, কোনও গেট খোলা নেই, কোনও আলোও জ্বলছে না। ফলে পুরোটা বুঝে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করতেই সময় লেগে যায়। আগুন-রোধী জ্যাকেট ও নিঃশ্বাস নেওয়ার মুখোশের অভাবেও দমকল নাস্তানাবুদ হয় বলে অভিযোগ।

গোটা বাড়িটি জুড়েই রয়েছে প্লাস্টিকের সরঞ্জাম, ঝুটো গয়না, ওষুধ, প্রসাধনী, খাতা-বই, হার্ডওয়্যারের দোকান ও গুদাম থেকে শুরু করে কাগজপত্র ঠাসা সিএ ফার্ম, আইনজীবীর চেম্বার, পরিবহণের অফিস। রয়েছে ওষুধের পাইকারি স্টক। এর আগেও ছোটখাটো আগুন লেগেছে বাগড়ি মার্কেটে। দমকল-পুরসভার পরিদর্শন কমিটি বারবার বলেছে, ভিতরে ডাঁই করা দাহ্য পদার্থ সরাতে। এ দিনের অগ্নিকাণ্ড দেখিয়ে দিল, কিছুই কানে তোলা হয়নি। ১১০০ ভাড়াটেয় ঠাসা বাড়িটিতে আগুন নেভানোর কোনও সরঞ্জামই কাজ করেনি বলে অভিযোগ। ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেবব্রত দাস ওরফে পল্টনবাবু থেকে কেয়ারটেকার অজয় তিওয়ারির দাবি, বাড়ির মালিক রাধা বাগড়ি ও তাঁর পরিজনেরা রক্ষণাবেক্ষণের পরোয়া করতেন না। পল্টনবাবুর বক্তব্য, গত কয়েক বছরে অগ্নিসুরক্ষার কথা বলে দফায় দফায় বেশ কয়েক লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন বাড়িওয়ালা। এ দিন রাধা বাগড়িকে নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন অনেক ভাড়াটেই। রাধাদেবীকে ফোনে পাওয়া যায়নি। সকাল সাড়ে ৭টায় তাঁর বাড়িতে গেলে বলা হয়, তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনিও। রাত পর্যন্ত কোনও মামলা দায়ের হয়নি। পুলিশ-সূত্রের বক্তব্য, কী ভাবে মামলা রুজু করা হবে তা নিয়ে শীর্ষ কর্তারা আলোচনা করছেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশ নিজে থেকে মামলা করতে পারে অথবা দমকলের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতেও মামলা রুজু হতে পারে।

গত বছর পাশে আমড়াতলি স্ট্রিটের একটি আগুনে বাগড়ি মার্কেটের পাম্পের জল কাজে লেগেছিল বলে ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি। এ যাত্রা কোনও লাভ হয়নি। কেয়ারটেকার অজয়ের দাবি, ''জলের পাম্প যেখানে, সেখানেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।'' বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সাহায্য নিয়ে বন্ধ শাটার, এসি-র খোপ কেটে, বেলা ১টারও পরে ক্যানিং স্ট্রিটের দিকে আগুনের কাছাকছি পৌঁছয় দমকল। তত ক্ষণে রবীন্দ্র সরণির দিকে মার্কেটের পাশের বাড়িতে ফাটল ধরেছে। চাঙড় খসে পড়েছে। বাড়ি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ছড়াতে শুরু করেছে। পাশেই রাসায়নিকের গুদাম। দুপুরের পর থেকে তা খালি করার কাজ শুরু হয়।

অগ্নিপরীক্ষায় ফেল সকলেই। এখন দ্বিতীয় পরীক্ষা— বাড়ি ভেঙে পড়াটা কি আটকানো যাবে? উত্তর দেবে সময়।