‘আমার মরা ছেলেটাকেও ওরা ছাড়ছে না’

তখনও দেহে প্রাণ রয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তোর এই সর্বনাশ কে করল? আমার বুকে মাথা দিয়ে বলল, মা পুলিশ আমাকে গুলি করেছে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। এ দিক ও দিক ছোটাছুটি করছি। ওঁর বাবাকে ডাকছি। বোনকে ডাকছি। এমন সময় দেখি ছেলেটা ঝিমিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে কোল খালি করে এ ভাবেই চলে গেল আমার মধু।

দোলঞ্চা নদীর পাড়ে ছেলের দেহ এখনও মাটি চাপা। বাড়ি থেকে কয়েক পা গেলেই ওই সমাধি। ছেলে ফিরে আসবে না জেনেও উঠোনে বসে 'মধু... মধু' করে ডেকে চলেছেন তাপস বর্মণের মা।

কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব, তার আগেই বললেন, ''কোথা থেকে এসেছো গো বাবা! একা? খুব সাবধান। ওরা কিন্তু সব নজর রাখছে।'' জিজ্ঞেস করলাম, কারা নজর রাখছে? জবাব এল, ''যাঁরা আমার ছেলেকে খুন করেছে, তাঁরা। এই তো দু'দিন আগে তাপসের ফোনে (ছেলের মোবাইল এখনও চালু) কে যেন ফোন করে বলল, বৌদি কোথায়? দেখো, তোমার ছেলের দেহ কবর থেকে তোলার চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম। দেখি আলো নেভানো। দূরে কয়েক জন দাঁড়িয়ে। পরে অবশ্য ওরা চলে গেল। আমার মরা ছেলেটাকেও ছাড়ছে না! সিবিআই চেয়েছি তো, এখন দেহটাই লোপাট করে দিতে চাইছে।''

বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল তাপসের বোন ডলি। মেয়েকে দেখিয়ে মঞ্জু দেবী বললেন, ''এই তো বোনকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। বলল, ভাল জায়গায় বিয়ে দেব। তার পর আমি বিয়ে করব। বোন তিরিশ টাকা দিয়ে একটা রাখি কিনে এনেছিল। রাখির দিন সেই যে পরেছে, আর খোলেনি। বলেছিল, যত দিন ভাল থাকবে হাতে পরে থাকব।''

ওই রাখি নিয়েই এখন মাটির নীচে শুয়ে রয়েছে মধু। তাপসের ডাক নামে এলাকায় মধুসূদন। আদরের নাম মধু। তিল তিল করে বাড়ির সামনেই তৈরি করেছিল মিষ্টির দোকান। এক দিকে কলেজের পড়াশোনা, অন্য দিকে দোকান সামলে পরিবারের হাল ধরেছিল মধু।

দাড়িভিটে সে দিনের গোলমালে কোনও রকম যোগ না থাকা সত্ত্বেও অকালে ঝরে গেল তরতাজা একটি প্রাণ। এ জন্য অবশ্য তাপসের পরিবার পুলিশ-প্রশাসনকেই দায়ী করছে। মঞ্জুদেবীর দাবি, ''গোলমালে পুলিশেরও অনেকে আঘাত পেয়েছেন। তাদের অতটা কিছু হয়নি। আর এ দিকে তিনটে ছেলের গুলি লাগল, তাদের হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে নিজেদের লোককে নিয়ে গেল ওরা। আর গুলিবিদ্ধ তিন জন পড়ে থাকল গ্রামেই। তাপস চলে গেল। রাজেশ চলে গেল। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে বিপ্লব।

অনেকেই দেখা করতে এসে অর্থ সাহায্যও করতে চেয়েছেন। আমি ওঁদের বলেছি, টাকা দিয়ে কি হবে রে বাপ। আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবি! ওই টাকা আমার লাগবে না। পারলে ছেলের খুনিকে ধরে দেখা। পুলিশের শাস্তি চাই।''