ক্ষতি কোটি কোটি

উৎসবের মরশুম আসন্ন। অন্যান্য বছরের মতোই বাজার ধরার লক্ষ্যে বাগরি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা কম–বেশি জিনিসপত্র মজুত করতে শুরু করেছিলেন। কয়েক ঘণটায় সব জ্বলেপুড়ে ছাই!

রবিবার সকালে বিষণ্ণ মুখে সেই কথাই বলছিলেন জুয়েলারি দোকানের কর্মী হীরেন দেশাই। সংস্থার কর্ণধার কেতন দেশাই ততক্ষণে বাক্‌রুদ্ধ। বাগরি মার্কেটে দেশাইদের দোকান এবং গোডাউন।

শনিবার রাত আড়াইটে নাগাদ বড়বাজারের ৭১, ক্যানিং স্ট্রিটের বাগরি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এমন বাক্‌রুদ্ধ হয়েছেন শ'য়ে শ'য়ে ব্যবসায়ী। ক্যানিং স্ট্রিটের ঘিঞ্জি এলাকার ছ'তলা বাড়িতে মোট ৮টি ব্লক। প্রতিটি ব্লকে ৮০ থেকে ১০০ করে দোকান। পুজোর আগে তাতে ঠাসা মালপত্র।  ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে আগুন জ্বলছে। ফুটপাথে ভিড় করে–থাকা ব্যবসায়ীদের চোখের সামনে পুড়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার মজুত জিনিস। জাভেরি জুয়েলার্সের কর্ণধার ৮ জন কর্মী নিয়ে পথে বসে রয়েছেন। চোখের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিচ্ছে ৪০ বছর ধরে একটু একটু গড়ে তোলা ব্যবসার ইমারত। 
তঁাদের মতোই অসহায় হয়ে পথে বসেছেন বাগরি মার্কেটের অন্তত ১২০০ ব্যবসায়ী। মার্কেটের ছ'তলা পর্যন্ত দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। দমকল কর্মীরা প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তঁারা একটি জায়গার আগুন নেভাচ্ছেন তো মার্কেটের অন্য কোনও অংশ থেকে লকলক করে উঠছে আগুনের শিখা। 
ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় দমকল কর্মীদের আগুন আয়ত্তে আনতে বেগ পেতে হয়েছে। মার্কেট এলাকার আকাশ ঢাকা পড়েছে হাজার হাজার তারের জঞ্জালে। ফলে হাইড্রোলিক ল্যাডার এনেও তা কাজে লাগানো যায়নি।  আগুন নেভাতে গিয়ে ৮ জন দমকলকর্মী আহত হন। ঘন কালো ধেঁায়ায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয় কয়েকজনের। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তঁাদের অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু চোখের সামনে দাউ দাউ করে গোটা মার্কেট জ্বলতে দেখে ব্যবসায়ীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তঁারা প্রশ্ন তুলেছেন মালিকপক্ষের ভূমিকা নিয়ে। এক ব্যবসায়ীর কথায়, 'মার্কেটে মেডিসিন, জুয়েলারি, প্লাস্টিক খেলনা, ব্যাগ, কাপড়, কসমেটিক সহ নানা মাল থাকে। অগ্নিনির্বাপণের জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খরচ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা করেনি মালিকপক্ষ।' আগুন লাগার পর মার্কেটের জলের লাইন কেন কাজ করল না, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। কলকাতার মেয়র শোভন চ্যাটার্জিও ঘটনাস্থলে দঁাড়িয়ে বলেছেন, 'অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে কি এই অবস্থা হত?' তবে পাশাপাশিই তঁার বক্তব্য, '‌ব্যবসায়ীদেরও একটা দায়িত্ব আছে। কী করে আগুন লাগল, তার বিস্তারিত তদন্ত হবে।‌'

বাগরি মার্কেটের মোট ৫টি গেট রয়েছে। লিফ্‌ট রয়েছে ২টি। স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের আধিকারিক আশুতোষ সিং এদিন ঘটনাস্থলে দঁাড়িয়ে বলেন, '‌রোজ মার্কেটে প্রচুর মানুষ আসেন রুজির জন্য। আগুনের জন্য ব্যবসায়ীদের কয়েকশো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।'‌

এরই মধ্যে যাঁদের দোকান কোনওক্রমে বেঁচে গেছে, সেই ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র গুটিয়ে নিচ্ছেন। বেশিরভাগ মুখ অবশ্য নাচার, অসহায় এবং হতাশ। যেমন শনিবার রাত সাড়ে ৩টে থেকে মার্কেটের উল্টো দিকে বিষণ্ণ মুখে বসে রয়েছেন ওষুধের হোলসেল ব্যবসায়ী মিলন সিং। তিনি বলছিলেন, '‌অনেকের রুজিরুটি জড়িয়ে রয়েছে এখানে। আগুনে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।  সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জানি না কীভাবে উঠে দঁাড়াব।'‌ শুধু ব্যবসায়ী নন। বাগরি মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল ২০০–রও বেশি কুলি–মুটে। ব্যবসা সংক্রান্ত পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত আরও অসংখ্য মানুষ।

চারদিকে পোড়া, কটু গন্ধ। মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে বাজারের ভেতর থেকে আসা বিস্ফোরণের আওয়াজ। ব্যবসায়ীরা জানালেন, শব্দ করে ফাটছে পারফিউমের সিলিন্ডার। কালো ধেঁায়ায় ঢেকে গেছে আশপাশের আকাশ। উল্টোদিকের বাড়ির ছাদ থেকে জল দিচ্ছেন দমকল কর্মীরা।  আশপাশের বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। যদি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে গোটা মার্কেটটাই! রাত থেকে ভোর। ভোর থেকে দিন গড়িয়ে রাত। জ্বলছে বাগরি মার্কেট।