কেরালার জন্য ৪০০০০ টাকা ত্রাণ রোহিঙ্গাদেরও


সরকারি খাতায় কলমে তাঁরা নিজেরাই 'উদ্বাস্তু'৷ এ দেশের সরকার চাইছে তাঁদের দেশ থেকে বাইরে বের করে দিতে৷ রাষ্ট্রশক্তির ইচ্ছের বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁরা দ্বারস্থ হয়েছেন সর্বোচ্চ আদালতের৷ সেখানেই পেয়েছেন সাময়িক স্বস্তি৷ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনভাবেই প্রতিক্রিয়ামূলক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না৷ 
এই অবস্থায় দিনের পর দিন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়ে, রাজধানী দিল্লির এক প্রান্তে খোলা আকাশের নীচে ত্রাণ শিবিরে রাত কাটিয়ে, কেরালার বন্যা দুর্গত মানুষদের দিকে ত্রাণ ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন দিল্লিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা৷ মানবিকতার সেরা উদাহরণ তুলে ধরে দিল্লির শ্রমবিহার, কালিন্দীকুঞ্জ এবং পার্শ্ববর্তী ফরিদাবাদে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা কেরালার বন্যাত্রাণে মোট ৪০,০০০ টাকা চাঁদা দিয়েছেন৷ প্রত্যেকে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী অনুদান দেওয়ার পরে তা তুলে দিয়েছেন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আধিকারিকদের হাতে৷ তাঁরাই এই অনুদান তুলে দেবেন কেরালা সরকারের প্রতিনিধিদের হাতে৷

পুরো উদ্যোগটির পিছনে রয়েছে রাজধানী দিল্লিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নিজস্ব ফুটবল ক্লাব 'রোহিঙ্গা শাইন স্টার'৷ যে দেশের সরকার আপনাদের তাড়াতে চাইছে প্রতিনিয়ত বেআইনি উদ্বাস্ত্ত আখ্যা দিয়ে, সেদেশের একটি রাজ্যের বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন কেন? শ্রমবিহারে ত্রাণ শিবিরে থাকা এক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ইমরান বলেন, 'আজ জুম্মা বার৷ সবে নমাজ পড়ে এলাম৷ আল্লার কাছে তো সবাই সমান৷ আজ আমাদের নিজেদের দেশে মায়ানমারের কোনও প্রদেশে যদি এমন ভয়াল বন্যা হত, তাহলে কি সেখানকার ভাই বোনদের পাশে দাঁড়াতাম না ? এটাও একই ব্যাপার৷ আমরা যা করছি, তা কেরালার ভাই বোনদের জন্য করছি, নিজের আত্মীয় ভেবেই করছি৷' 

শাইন স্টার ফুটবল ক্লাবের ম্যানেজার মহম্মদ শাহিদ বললেন, 'আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রোহিঙ্গাদের নিয়ে গিয়ে চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচ খেলে ত্রাণ সংগ্রহ করব'৷ অসাধারণ ভাবনা শোনার পরে মনে একটাই প্রশ্ন উদয় হল, ফুটবল নগরী কলকাতার তিন প্রধান কেন এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে না ?

দক্ষিণ দিল্লির কালিন্দী কুঞ্জ এলাকায় মায়ানমার থেকে এসে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা নিজেরাই প্রতিনিয়ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে থাকেন৷ গত এপ্রিলে তাদের অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়৷ এমন ভয়াবহ ছিল মাঝ রাতে লাগা সেই আগুন যে, রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে পাওয়া উদ্বাস্তু সার্টিফিকেট ও পরিচয় পত্র টুকুও বাঁচাতে পারেননি কোনও রোহিঙ্গাই৷ তারপরেও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই করছেন কেন্দ্রীয় সরকারের মতবাদের সঙ্গে৷ কেন্দ্রীয় সরকার বারবার জানিয়েছে যে, এদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড়রকমের বিপদ ডেকে আনতে পারেন মায়ানমার থেকে পালিয়ে এখানে শরণ নেওয়া রোহিঙ্গারা৷ সেই অবস্থাতেও তারা বিপদে পড়া কেরালার জনগণকে সাহায্য করার কথা ভাবছেন, এটাকে বড় কথা বলে মানতে নারাজ রোহিঙ্গাদের অনেকেই৷ 

আর এক শরণার্থী আবদুল্লাহর কথায়,'আমরা নিজেরা বিপদগ্রস্ত বলেই তো অন্যদের বিপদের কথা ভাল বুঝতে পারি৷ উপরওয়ালা আমাদের বুঝিয়েছেন আসল বিপদ কাকে বলে৷ ভিটে মাটি ছাড়া হয়ে বিদেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, দু মুঠো ভাতের সন্ধানে উঞ্ছবৃত্তি করা, কোনওরকমে পরিবার প্রতিপালন করা, তার উপরে প্রতিমুহূর্তে বিদেশী রাষ্ট্রের চোখরাঙানি, এর থেকে বড় বিপদ আর আমাদের জীবনে কী হতে পারে ? এই সব অভিজ্ঞতা থাকার পরে আমাদের মনে হয়েছে বিপদগ্রস্ত কেরালার মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা আমাদের কর্তব্য৷ মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত যদি না বাড়িয়ে দেই, তাহলে কী ভাবে জবাব দেব আল্লার কাছে?' তাঁর কথা শুনে মুহূর্তে ভেঙে যায় দেশ, কাল, স্থান ও জাতির বেড়া৷ জেগে থাকে শুধু একটাই চর, মানবতা- বানভাসি কেরালার 'সাহায্যকারী' রূপে৷