‘মাথার ছাদ চলে গেল, কী ভাবে সব বইপত্র কিনে পরীক্ষা দেব?’


সন্ধান: ছাইয়ের স্তূপে বই-খাতার খোঁজে কিরণ। রবিবার, হাওড়ার বেলগাছিয়ায়।


এক ঘর ছাইয়ের মধ্যে খুঁজেই চলেছে কিরণ। যদি কিছু বেঁচে গিয়ে থাকে! সামনের বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে সে। জোরকদমে প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু বিধ্বংসী আগুনে ছাই হয়ে গিয়েছে ঘরের সমস্ত জিনিস। কিরণের বই-খাতা তো বটেই, পুড়ে গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্রও।

শনিবার রাতে হাওড়ার বেলগাছিয়ায় বেনারস রোডের পাশে একটি রাসায়নিক কারখানায় লাগা আগুন এ ভাবেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে কম করে ৮০ জন বাসিন্দার গেরস্থালি। পুড়ে গিয়েছে কম করে ন'টি বাড়ি এবং সাতটি দোকান। কিরণের মতোই বই-খাতা, শংসাপত্র ছাই হয়ে গিয়েছে আরও কয়েক জন পড়ুয়ার। মাথার উপরের ছাদ, ঘরের সব জিনিসপত্র হারিয়ে মানুষগুলির এখন ভরসা পুরসভার দেওয়া দুধ-রুটি আর ত্রিপল।

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ হাওড়া পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ওই কারখানায় আগুন লাগে। ঘনবসতির্পূণ এলাকায় অবস্থিত ওই কারখানার ভিতরে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক মজুত থাকায় মুহূর্তেই আগুন ভয়াবহ আকার নেয়। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বসতবাড়ি ও দোকানঘরগুলিতে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কারখানা লাগোয়া বাড়িগুলি থেকে বাসিন্দারা কোনও রকমে বেরিয়ে এসেছিলেন রাস্তায়। চোখের সামনে নিজেদের বাড়ি-সহ সমস্ত জিনিস পুড়তে দেখলেও কিছুই করতে পারেননি বাসিন্দারা। দমকলের ১২টি ইঞ্জিন এসে প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও তত ক্ষণে সম্পূর্ণ পুড়ে যায় বাড়ি এবং দোকানঘরগুলি।

রাতেই হাওড়া সিটি পুলিশ এবং স্থানীয় কাউন্সিলর বিভাস হাজরার উদ্যোগে বামনগাছির একটি স্কুলে গৃহহারা বাসিন্দাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। আগুনে কতটা ক্ষতি হয়েছে তা শনিবার রাতে ঠিক বোঝা না গেলেও রবিবার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বোঝা যায়। রবিবার সকালে পোড়া বাড়ির সামনে বসে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছিলেন শীলা মাহাতো। স্বামী সঞ্জীব আর দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন তিনি। শীলা বলেন, ''আগুন‌ লাগার পরে শুধু ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমি আর আমার স্বামী বেরিয়ে এসেছিলাম। এমনকি মোবাইলটাও নিয়ে আসতে পারিনি। কাউকে খবরটা অবধি দিতে পারছি না।''

আর এক বাসিন্দা মীনা মাহাতোর অভিযোগ, ''এই কারখানাটা বেআইনি। কটূ গন্ধে টেকা যায় না। গোটা এলাকায় দূষণও ছড়ায়। অভিযোগ করেও কোনও লাভ হয়নি। আজ ওই কারখানার জন্যই আমার মাথার ছাদ চলে গেল। কী খাব, কী পরবো জানি না।'' কিরণ মাহাতো নামে ওই ছাত্রী বলে ''আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। কী ভাবে সব বইপত্র কিনে পরীক্ষা দেব? মাথার উপর চালটাও নেই।''
হাওড়ায় দমকলের প্রধান প্রশান্ত ভৌমিক এ দিন বলেন, ''ওই কারখানায় অগ্নি-সুরক্ষার প্রাথমিক ব্যবস্থাও ছিল না। বেশ কিছু জিনিস আমাদের চোখে পড়েছে। কারখানার মালিকের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা সব দিক খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।''

রবিবারও সকাল থেকে পুর কর্মী এবং দলীয় কর্মীদের নিয়ে ত্রাণ বিলি করেন কাউন্সিলর বিভাসবাবু। তিনি বলেন, ''আপাতত সকালে দুধ-রুটি আর দুপুরে ভাত-ডাল-সব্জি ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ত্রিপলও দেওয়া হয়েছে। মেয়র রথীন চক্রবর্তী রাতে পুরো পরিস্থিতির উপরে নজরদারি করেছেন।''
এ দিন মেয়রের নির্দেশে ঘটনাস্থলে আসেন পুর কমিশনার বিজিন কৃষ্ণা। তিনি বলেন, ''ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের জন্য প্রাথমিক সাহায্য সবই করা হচ্ছে। ত্রাণ শিবিরও খোলা হয়েছে। বাসিন্দাদের মোট কত ক্ষতি হয়েছে তা আমরা খতিয়ে দেখে জেলা প্রশাসন‌কে রিপোর্ট দেব। এর পরে রাজ্য সরকার বাড়ি তৈরি বা অন্যান্য ব্যাপারে সাহায্য করবে।''