টিনএজ প্রেমে ‘ডেটিং ভায়োলেন্স’-এর বেশি শিকার ছেলেরা! কলকাতার হাল কী?



সাইকেলটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো। বছর পনেরোর কিশোরের ছেঁড়া শার্ট, চোখে জল।পছন্দের মেয়েটির বাড়িতে সে দিন একটা জিনিস পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। দেরি হওয়ায় সম্পর্ক তো শেষ, উল্টে মারধরও জুটেছে খোদ মেয়েটির হাতে।

কয়েক বছর আগে ফেসবুকে এমন একটি ছবি নাড়া দিয়েছিল অনেককেই। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস পেরিয়ে 'মেয়েদের হাতে মার খেলি' গোছের সস্তা তামাশাও জুটেছিল সে ছবির কপালে। যেন মেয়েদের হাতে মার খাওয়ার ঘটনা বড়ই বিরল ও অবাস্তব! কিন্তু কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া (ইউবিসি) ও সিমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটি (এসএফইউ)-র গবেষণা কিন্তু সেই 'ডেটিং ভায়োলেন্স'-এর ছবিকেই মান্যতা দিচ্ছে।

সম্প্রতি এদের যৌথ গবেষণা প্রকাশিত হয় 'জার্নাল অব ইন্টারপার্সোনাল ভায়োলেন্স'-এ। তাতে দাবি করা হয়, টিনেজে বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর-কিশোরীর সম্পর্কে শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয় ছেলেটিই। গবেষকদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী,২০১৭-তে ৫.৮ শতাংশ কিশোর তাদের কিশোরী প্রেমিকার হাতে মার খেয়েছে। নেহাত মজা বা খুনসুটির মার যা মোটেও নয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হার শতকরা ৪.২ শতাংশ।যদিও আশার কথা, ২০০৩ সালে এই ধরনের অভিযোগ জমা পড়ার যে খতিয়ান তা ২০১৩-য় এসে খানিক কমেছে। ২০০৩-এ পুলিশের কাছে প্রায় ছয় শতাংশ টিনেজার কিশোর এমন অভিযোগ জানিয়েছিল। ২০১৩-য় সে হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে।

সিমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটির পিএইডি-র ছাত্রী ও অন্যতম গবেষক ক্যাথরিন শাফারের মতে, বিশ্বের প্রায় সব দেশের সমাজ ব্যবস্থাতেই মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া নিয়ে আইনি রক্ষাকবচ আছে। ছেলেদের গায়ে হাত তোলা নিয়ে সে সব আইন অনেকটাই শিথিল। টিনেজ ডেটিংয়ে তারই শিকার ছেলেরা।এই ধরনের ছেলেদের মধ্যে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ে। তবে দশ বছরের ব্যবধানে এই পরিসংখ্যান কমায় সুস্থ সম্পর্কের জোর বাড়ছে বলেই দাবি গবেষকদের।

প্রথমে কানাডা ও পরে উত্তর আমেরিকা জুড়ে এই গবেষণা চালান গবেষকরা। ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিল সাত থেকে বারো বছর বয়সি প্রায় ৩৫,৯০০ জন কিশোর-কিশোরী। তাদের ব্যবহার, অভিজ্ঞতা, আবেগ ও সম্পর্ক নিয়ে মনোভাবের উপর ভিত্তি করেই রিপোর্ট তৈরি করেন গবেষকরা। তবে তাঁদের দাবি, গোটা বিশ্বেই এই ছবি কম-বেশি এক।

এলিজাবেথ সিউইক, ইউবিসি-র গবেষক-অধ্যাপক জানান, ''আমাদের ধারণা রয়েছে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাধারণত, মেয়েরাই বেশি নরম অবস্থান নেন ও সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করেন ছেলেরাই। কিন্তু এই সমীক্ষা ধারণার উল্টো দিকটাই স্পষ্ট করছে।'' স্কুল-অভিভাবক-আত্মীয়-বন্ধু সকলেরই এই সময় নির্যাতিত কিশোরের পাশে থাকা উচিত। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রেমজ সম্পর্ক সংক্রান্ত সচেতনতাও আরও বৃদ্ধি করা উচিত বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি।

কোথায় দাঁড়িয়ে কলকাতা
গবেষকরা দেশ নির্বিশেষ এই ছবি 'একই' বলে দাবি করলেও কলকাতার মনোবিদদের তেমন সায় নেই এতে। মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন এমন গবেষণায় সহমত হতে পারলেন না গবেষকদের সঙ্গে। তাঁর মতে, অস্বীকার করার উপায় নেই, ভারতীয় সমাজে এখনও মেয়েরা কোণঠাসা। সেখানে শহর কলকাতাও বাদ পড়ে না। এখানে দাঁড়িয়ে টিনেজ প্রেমে ছেলেরা বেশি মার খাচ্ছে মেয়েদের হাতে, এমনটা বলে দেওয়া যায় না। বরং বলতে পারি, কম বয়সের প্রেমে আবেগ বেশি থাকে। দু'পক্ষই সমাজ ও পরিবারের ভয়ে লুকিয়ে প্রেম করে, ফলে তাদের অসহায়তাও বেশি থাকে। তাই অস্থিরতার কবলে পড়ে ঘনঘন ঝগড়া, ভুল আবেগের বাড়াবাড়িতে আত্মহত্যা এমন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে তারা। কিন্তু সেটা মোটেই লিঙ্গভেদে সাধারণীকরণ করা উচিত নয়। কোথাও ছেলেটি মার খেলে কোথাও মেয়েটিও নানা অত্যাচারের শিকার হয়। কে কতটা ক্ষমতাশালী তার উপরই এটা নির্ভর করে। বিদেশের গবেষণা এ দেশের জন্যও যে প্রযোজ্য হবে তা ভেবে নেওয়ার কোনও মানে নেই।

একই মত মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়েরও। তাঁর মতে, যে কোনও বয়সের যে কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ক্ষমতার বিন্যাস মানুষকে চালিত করে। আর ক্ষমতা তো শুধু লিঙ্গভেদে আসে না। বিত্ত, সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা— আরও অনেক কিছু জুড়েই এই 'ক্ষমতা'-র সংজ্ঞা নির্ণয় করা হয়। বরং এমন ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় প্রেমে অন্ধ হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া, প্রেমের জন্য জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজকে অবহেলা, প্রেমে আঘাতে আত্মহত্যা এ সব ঘটনা আমাদের এখানে আকছার ঘটে। মারধর-ঝগড়াঝাঁটিও হয়। তবে তাতে দু'পক্ষই যুক্ত। শহর কলকাতার কিশোরীরা প্রেমে মারধর করছে বেশি, আর কিশোররা মুখ বুজে মার খাচ্ছে— এমন কোনও উপসংহারে পৌঁছনো ঠিক হবে না।