পুজোয় আর্থিক সমস্যা, স্ত্রী-কন্যার গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা গৃহকর্তার

ঘরের দরজা খোলার পর আঁতকে উঠেছিলেন পুলিশ আধিকারিকরাই। ঘরের মধ্যে থাকা দম্পতির গলার অংশ কাটা। দু'জনের গলা থেকেই বেরিয়ে আসছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। ঘরের মেঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রক্তের দাগ। এমনকী, বারান্দায়ও রয়েছে রক্তের ছাপ। বিছানায় প্রায় অচেতন অবস্থায় শুয়ে রয়েছে দম্পতির সাত বছরের মেয়ে। তার গলাও কাটা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা।

পুজোর আগেই আর্থিক সমস্যা। আর তা থেকেই হতাশা। তারই জেরে স্ত্রী ও নিজের শিশুকন্যার গলা কেটে খুনের চেষ্টার পর নিজের হাতের শিরা ও গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন বাড়ির কর্তা। এমনই অভিযোগ পুলিশের। বুধবার সকালে দক্ষিণ কলকাতার রিজেন্ট পার্ক এলাকার মুর অ্যাভিনিউয়ে ঘটল এই ঘটনা। পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, এই ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পুলিশ বাড়ির কর্তার বিরুদ্ধে স্ত্রী ও মেয়েকে খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করছে। যদিও স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী কোনও অভিযোগের আঙুল তোলেননি। পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগও করেননি। বরং জানা গিয়েছে, ওই গৃহবধূ পুলিশকে প্রথমে জানান, তিনি নিজেই তাঁর গলা কাটেন। তাঁরা দু'জনেই জানতেন, তাঁরা কী করতে চলেছেন। তাঁদের যদি মৃত্যু হয়, শিশুটিকে দেখার কেউ থাকবে না। সেই কারণেই এই কঠোর সিদ্ধান্ত। যদিও বাড়ির কর্তা পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি স্ত্রীর গলায় আঘাত করার আগে স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে পড়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। স্বামী বলেন, তাঁর বাঁচার ইচ্ছা নেই। তাঁর মৃত্যু হলে পরিবারের অন্যদের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। তাই তিনি তাঁদেরও মারতে চান। প্রায় দশ মিনিট ধরে স্ত্রীর মগজধোলাই করেন স্বামী। শেষ পর্যন্ত স্ত্রী রাজি হয়ে গেলে গৃহকর্তা তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের গলা কাটেন। তবে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আঘাতগুলি পরীক্ষা করতে পারেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।

পুলিশ জানিয়েছে, এদিন সকালে ওই গৃহবধূ তাঁর এক দাদাকে ফোন করে বলেন, নিজেদের গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। সেই ফোন পেয়ে রিজেন্ট পার্ক এলাকারই গঙ্গাপুরী থেকে তাড়াতাড়ি মুর অ্যাভিনিউয়ে বোনের বাড়ি চলে আসেন পেশায় চিকিৎসক ওই আত্মীয়। রক্তাক্ত অবস্থায় তিনজনকে দেখে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু সকাল ৬টা নাগাদ কোনও অ্যাম্বুল্যান্স না পেয়ে তিনি কাছেই রিজেন্ট পার্ক থানায় ছুটে যান। কর্তব্যরত পুলিশ আধিকারিকদের ঘটনাটি জানানো মাত্রই পুলিশ নিজেদের অ্যাম্বুল্যান্স 'কর্মা' ডেকে আনে। 'কর্মা'য় করে প্রথমে শিশুটিকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর একে একে তার মা ও বাবাকে। প্রাথমিক অস্ত্রোপচারের পরও শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার শরীর থেকেই বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে বেশ কয়েক বোতল রক্তও দেওয়া হয়। তার মা-বাবাও হাসপাতালে ভর্তি। জানা গিয়েছে, গলা কাটলেও শ্বাসনালি না কেটে যাওয়ায় বেঁচে গিয়েছেন তাঁরা। পুলিশের কাছে খবর, রাত প্রায় দু'টোর সময় এই ঘটনাটি ঘটে। তবু ভোরে কেন গৃহবধূ দাদাকে ফোন করেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

মুর অ্যাভিনিউয়ে ওই দম্পতির নিজের বাড়ি। সঙ্গে থাকেন গৃহকর্তার মা-ও। বছর তিনেক আগে মৃত্যু হয়েছে বাবার। বাড়ি লাগোয়া রয়েছে একটি দোকান। সেটি বিশেষ চলে না। গৃহকর্তা একটি আইটি সেক্টরে চাকরি করতেন। কিন্তু সেখানে তাঁর চাকরি নিয়ে সমস্যা হয়। তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। মাস দু'য়েক আগে তিনি অন্য একটি আইটি সংস্থার 'পরিবহণ' বিভাগে যোগ দেন। কিন্তু আর্থিক সমস্যা তাঁর কাটেনি। এলাকা সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁর মাথায় ছিল ঋণের বোঝা। চাকরি করলেও ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স নেমেছিল তলানিতে। ফের ঋণ নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। এমনকী, পুজোর আগে কীভাবে স্ত্রী, মেয়েকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেবেন, তা-ও জানতেন না ওই ব্যক্তি। আর্থিক কারণে সাংসারিক সমস্যাও দেখা দেয়। দিন দু'য়েক আগে তাঁর মা বাপের বাড়িতে যান। যদিও প্রতিবেশী তথা আত্মীয়রা জানান, কোনওদিন তাঁরা সংসারে চেঁচামেচি শোনেননি। দম্পতি মেয়েকে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। মেয়ে নাচও শেখে। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠে। তাই আর্থিক সমস্যা নিয়েও চলছে পুলিশের তদন্ত। দম্পতিকে আরও জেরা করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷