আলোচনার সদিচ্ছা আদৌ রয়েছে তো পাকিস্তানের?

'কথা' কি শুধুই 'কথার কথা'? দ্বিপাক্ষিক 'কথা' শুরু করার যে কথা পাকিস্তান বলছে, তা কি 'কাজের কথা' হয়ে উঠবে না কোনও দিনই? এক দিকে নানা আন্তর্জাতিক মঞ্চে এবং আন্তর্জাতিক মহলকে শুনিয়ে বলার নানা মাধ্যমে পাকিস্তান বলছে, ভারত ভেস্তে দিচ্ছে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বা শান্তি স্থাপনের যাবতীয় প্রচেষ্টা। অন্য দিকে ক্রমাগত চলছে প্ররোচনা, হিংসা, সন্ত্রাসে মদত। ইমরান খান কি সত্যিই কোনও নতুন পাকিস্তান রচনা করতে চাইছেন? নাকি পুরনো পাকিস্তানকেই নতুন ভাবে দেখানোর কূটকৌশল রচনা করতে চাইছেন?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। জন্মলগ্ন থেকে পরস্পরের সঙ্গে বিবদমান ভারত ও পাকিস্তান। এই বিবাদে কোনও পক্ষেরই লাভ নেই। দু'পক্ষেরই ক্ষতি, কারও একটু কম, কারও একটু বেশি। তাই শান্তির পথে বা বিবাদ মেটানোর পথে পা ফেলাই যে শ্রেয় তা বোঝার জন্য কূটনীতি বা রাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর বিবাদ মেটানোর জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বা কথোপকথন বাড়ানোই যে একমাত্র পথ, তাও সম্ভবত দু'পক্ষই বোঝে। তবু আলোচনা হয় না, আলোচনার প্রয়াস বারবার ভেস্তে যায়।

ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সাম্প্রতিকতম প্রস্তাবটি পাকিস্তানের দিক থেকেই এসেছিল। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। ভারতও রাজি হয়ে গিয়েছিল, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার পরে ভারতই আলোচনা বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছে। নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার বৈঠকের ফাঁকে আয়োজিত সার্ক দেশগুলির বৈঠকে ভারত-পাকিস্তানের মুখোমুখি হওয়ার যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, সেটুকুও আর বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থেকে বিদেশমন্ত্রী, প্রত্যেকেই আঙুল তুলতে শুরু করেছেন ভারতের দিকে। ভারতই আলোচনা চাইছে না, ভারতই বৈঠক ভেস্তে দিচ্ছে, ভারতই শান্তির বিপক্ষে কাজ করছে— পাকিস্তানের দিক থেকে এই জাতীয় অভিযোগ তোলা শুরু হয়েছে।

ভারতই দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু কেন বারবার ভেস্তে যাচ্ছে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রক্রিয়া, নেপথ্যে ঠিক কী ঘটে যাচ্ছে, সে দিকেও তো নজর দেওয়া দরকার। আলোচনার বিষয়ে ভারতের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট— সস্ত্রাস ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না। আগে সন্ত্রাসে মদত দেওয়া বন্ধ করতে হবে, তারপরে আলোচনা শুরু হবে— অজস্র বার এ কথা জানিয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু প্রত্যেক বারই ঘটনাপ্রবাহ উল্টো দিকে যায়। আলোচনার চেষ্টা শুরু হলেই ভারত-পাক সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে অথবা নিয়ন্ত্রণরেখা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

এবারে চেনা খাতেই গড়িয়েছে ঘটনাপ্রবাহ। একদিকে ইমরান খান আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। অন্যদিকে ভারতীয় জওয়ানের মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছে পাকিস্তানিরা। সেই ভয়ানক ঘটনার প্রতিবাদেই আলোচনা বাতিল করেছে ভারত। পাকিস্তান অবশ্য তাতে থমকে যায়নি। পাক প্রধানমন্ত্রী বেশ অসৌজন্যমূলক একটি টুইটে নিশানা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর এসেছে, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গি লঞ্চ প্যাডগুলিতে বহু সন্ত্রাসবাদী জড়ো হয়েছে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরনোর লক্ষ্যে। আর সব শেষে পাকিস্তানের সরকারি বাহিনী আকাশ সীমা লঙ্ঘন করল। জম্মুর আকাশে ঢুকে পড়ল পাকিস্তানি কপ্টার।

এই হল ইমরান খানের নতুন পাকিস্তানের নমুনা? সীমান্তে বা নিয়ন্ত্রণরেখায় সেই একই নৃশংস আচরণ, কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী অনুপ্রবেশ ঘটানোর অনর্গল প্রয়াস, আরও নানা ধরনে র প্ররোচনা— পারভেজ মুশারফ বা বেনজির ভুট্টো বা নওয়াজ শরিফের আমলে যেমনটা ঘটত, এখনও তেমনই। কীসের ভিত্তিতে ইমরান খান বলছেন যে, তাঁর অধীনস্থ পকিস্তান এক নতুন পাকিস্তানের রূপ নিতে চলেছে? তিনি সত্যিই ভারতের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় আগ্রহী, এমন প্রমাণই বা মিলছে কোথায়? যদি ধরে নিই, ভারত-পাক শান্তি আলোচনায় ইমরান সত্যিই আগ্রহী, তাহলে বুঝতে হবে যে, পাকিস্তান ইমরানের নিয়ন্ত্রণে নেই। আর যদি ধরে নিই, পাকিস্তান ইমরানের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে, যাবতীয় নৃশংসতা, প্ররোচনা, হিংসা তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই চলছে।

যদি ইমরানের অঙ্গুলিহেলনে বা অনুমোদনে এই সন্ত্রাস চলে, তাহলে ইমরানের আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। আর যদি এমন হয় যে, পাকিস্তান ইমরানের নিয়ন্ত্রণে নেই, তাহলেও ইমরানের সঙ্গে আলোচনা অর্থহীন। কারণ, সে আলোচনার সিদ্ধান্ত ইসলামাবাদে কোনও ছাপ ফেলবে না।

সব শেষে আবার বলি, ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। এই উপমহাদেশের জন্য তো বটেই, গোটা বিশ্বের জন্যই তা জরুরি। কিন্তু তার আগে জরুরি আলোচনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। সেই দায়টা পাকিস্তানকেই নিতে হবে।