বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো কোথায় হয়েছিল?


লাল মাটির আঁকাবাঁকা পথ, যার দু'পাশে শাল-সেগুনের গাঢ় সবুজ জঙ্গল, আর বাহারি প্রকৃতির হাত ধরে সোজা গিয়ে থামতে হয় মেধসাশ্রমে। সেখানেই বিরাজ করেন মা অষ্টভূজা সিংহবাহিনী।


অষ্টভূজা সিংহবাহিনী মায়ের মন্দির।
পুজো আসছে ভাবলেই ভীষণ এক ভাললাগা, আর তার সঙ্গে দিন গোনাও শুরু মনে মনে। পুজো মানেই তো ঠাকুর দেখার আনন্দ, নতুন সাজ-পোশাক, আলোর রোশনাই, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা— এক অফুরন্ত ছুটির মেজাজ। 


পুজোর আরও একটি দিক হল— টুক করে বেরিয়ে পড়া, কাছে দূরে যেখানেই হোক। চেনা ছক থেকে বেরিয়ে ছুটির মজার আলাদাই স্বাদ। আর তার সঙ্গে যদি উপরি হিসেবে পাওয়া যায় পুজোর গন্ধ, তা হলে তো কথাই নেই। 
এই বাংলাতেই এমন এক জায়গা রয়েছে যেখানে পুজোর বাদ্যি উপভোগ করা যায় ছুটিকে ভর করেই। নাম, গড়জঙ্গল।

ঘন সবুজ আর লাল মাটির রহস্য মাখা ইতিহাস হাতছানি দিয়ে ডাকে যেন সবাইকে। লাল মাটির আঁকাবাঁকা পথ, যার দু'পাশে শাল-সেগুনের গাঢ় সবুজ জঙ্গল, আর বাহারি প্রকৃতির হাত ধরে সোজা গিয়ে থামতে হয় মেধসাশ্রমে। সেখানেই বিরাজ করেন মা অষ্টভূজা সিংহবাহিনী।

কথিত, রাজা সুরথ এখানেই প্রথম দুর্গা পুজো করেছিলেন। মেধস মুনির কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েই সুরথ রাজা এ স্থানে পুজো করেন বলে জায়গার নাম মেধসাশ্রম। সে দিক থেকে বলা যায় যে, সুরথ রাজার সেই পুজোই ছিল বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো।

প্রকৃতির মাঝে এই আশ্রমে পাখির কিচিরমিচির ছাড়া আর কোনও শব্দই প্রায় শোনা যায় না। তবে পুজো শেষে 'বন্দে মাতরম্' শুনে বেশ চমকে গিয়েছিলাম। পূজারীর কাছে কারণ জানতে চাওয়ায় যা শুনলাম, তাতে গায়ে কাঁটা দেয়। ইংরেজ আমলে অনেক বিপ্লবীই নাকি এই মন্দিরের দেবীকে দেশমাতৃকার রূপে পুজো করতেন। সেই সময় থেকেই চলে আসছে পুজোর সময়ে 'বন্দে মাতরম্' ধ্বনি দেওয়ার রীতি। 

শোনা যায়, দেবী চৌধুরানিও নাকি এখানে পুজো দিয়েছেন। 

গড়জঙ্গলের আশেপাশেই রয়েছে এগারো হাত কালী মন্দির, মহালক্ষ্মী মন্দির ও মহাকাল মন্দির। এ অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। রয়েছে একটি অতি প্রাচীন তেঁতুল গাছ, যার তলায় বসে ধ্যান করতেন মেধস মুনি। 

গড়জঙ্গলের আরও একটি বিখ্যাত মন্দির রয়েছে যেখানে 'ধর্মমঙ্গল'-এর ইছাই ঘোষ পুজো করতেন। শ্যামারূপা মায়ের মন্দির, যেখানে রয়েছে শ্বেত পাথরের ছোট একটি দুর্গা মূর্তি। প্রসঙ্গ, বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি, জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' কাব্যতে উল্লেখ পাওয়া যায় শ্যামারূপা দুর্গার।  বলা হয়, শ্যাম বা কৃষ্ণ ও দুর্গার রূপ দেখা যায় এই মূর্তিতে, তাই এমন নাম।

শ্যামারূপা মন্দিরের কিছু দূরেই রয়েছে ইছাই ঘোষের দেউল। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে অজয় নদ। দেউলের প্রবেশ পথেই রয়েছে আর্কিওলজিকাল সার্ভের একটি বোর্ড। সেখান থেকেই জানলাম, ৫০ ফুট উচ্চতার দেউলটি মধ্য অষ্টাদশ শতকের। 


মনে মনে হিসেব কষলাম— ইতিহাস বলছে, মন্দিরটি পাল আমলের। অন্য দিকে সেন বংশের ছোঁয়া। রয়েছেন ইছাই ঘোষ। পুরাণ বলছে রাজা সুরথের কথা। আবার দেবী চৌধুরানি, ভবানী পাঠক থেকে ইংরেজ যুগের বিপ্লবী— গড়জঙ্গলের এই মন্দিরের ঐতিহ্য নিয়ে আর না ভাবাই ভাল!
আরও যা দেখতে পারেন
প্রকৃতি ও ইতিহাসের মেলবন্ধন, সঙ্গে নিশ্চুপ পরিবেশে পুজোর আনন্দ— গড় জঙ্গলের দুর্গা পুজো যে কেউ উপভোগ করবেন, এমন কথা হলফ করে বলা যায়। চাইলে এক দিনে ফিরে আসতেই পারেন। না হলে একটি ছোট ট্যুর প্যাকেজ করে নিন। গড়জঙ্গল থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরত্বেই রয়েছে ইস্পাত নগরী দুর্গাপুর। আর আশেপাশে রয়েছে বিষ্ণুপুর, মুকুটমণিপুর, মাইথন, পাঞ্চেত, গড়পঞ্চোকোট।


যাতায়াত

গাড়ি
কলকাতা থেকে সড়কপথেই যাওয়া সুবিধা। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সোজা পানাগড় হয়ে দার্জিলিং মোড়। মোড় থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে পৌঁছতে হবে এগারো মাইল। সেখান থেকে বাঁদিকের রাস্তায় গেলে পড়বে ইছাই ঘোষের দেউল। সেখান থেকে জঙ্গলের মধ্যে ২-৩ কিলোমিটার গেলেই রয়েছে মেধসাশ্রম ও শ্যামারূপা মন্দির।


রেল

কলকাতা থেকে যে কোনও ট্রেনে দুর্গাপুর। সেখান থেকে ঘন ঘন বাস পাওয়া যায়। চাইলে গাড়িও পেয়ে যাবেন স্টেশনের বাইরে থেকে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য

• দুর্গাপুরে থাকার প্ল্যান করলে সিটি সেন্টার, গাঁধী মোড় বা ভিড়িঙ্গি মোড়ে থাকতে পারেন। ছোট-বড় নানা ধরনের হোটেল রয়েছে এই জায়গাগুলোতে। স্টেশনের কাছের হোটেলগুলোতে না থাকই ভাল।

• মন্দিরগুলো যেহেতু ঘন জঙ্গলের মধ্যে, তাই পুজোর সময় বাদ দিয়ে অন্য সময়ে গেলে, দিনের বেলায় যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।

• মন্দিরে পুজো দিতে চাইলে, সামগ্রী কিনে নিয়ে যাওয়াই ভাল। কারণ, আশেপাশে কিছু পাওয়া যায় না।