আনারসের পাতা থেকে সুতো


রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'খোসা হইতে আঁটি পর্যন্ত কিছুই ফেলা যাইবে না।' আনারসের ক্ষেত্রে তা-ই হতে চলেছে। আনারসের নাম শুনলেই তো জিভে জল আসে। মিষ্টি, রসাল সুস্বাদু ফল। খেত থেকে তোলার সময় আনারসের সঙ্গে থাকা পাতাগুলি কেটে ফেলে দেওয়াই দস্তুর। কিন্তু গবেষণায় সেই পাতা ব্যবহারের উপায় পাওয়া গিয়েছে। আনারসের পাতা থেকে সুতো বের করে নেওয়া সম্ভব। সেই সুতো ফেলে দেওয়ার নয়। তা দিয়ে ব্যাগ, কুশন, পাপোস তো বটেই, শাড়িও বোনা যায়। মালয়েশিয়ায় অনেক দিন ধরেই তা হচ্ছে। এ বার ভারতেও হতে যাচ্ছে। শিলিগুড়ির কাছে আনারস আবাদের জন্য বিখ্যাত বিধাননগরে পাতা থেকে ওই সুতো বানানো শিখছেন একদল মহিলা। আনারস পাতা থেকে সুতো তৈরি কিন্তু কঠিন কিছু নয়। আনারসের পাতাকে ধারালো কিছু দিয়ে চাঁছলেই ভিতরে সুতো দেখতে পাওয়া যায়। টেনে নিলেই হল। আবার ওই পাতা ৩-৪দিন জলে পচালেও সুতো বেরিয়ে আসে।

পদ্ধতি আরও সহজ করতে বাজারে যন্ত্রও এসে গিয়েছে। পাতার জোগান থাকলে দিনে এভাবে অন্তত কয়েক কেজি সুতো বার করা সম্ভব। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অন জুট অ্যান্ড অ্যালায়েড ফাইবার টেকনোলজির সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই সুতোর বাজার আছে কলকাতায়। চুলের বিনুনির মতো ওই সুতোর ১০০ ফুট লম্বা লাচি তৈরি করতে পারলেই তা বিক্রি হবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। রাজ্যের মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প দপ্তর বিধাননগরের মহিলাদের সমবায়কে আনারস পাতা থেকে সুতো তৈরির যন্ত্রটি কিনে দিচ্ছে। রবিবারই স্থানীয় ৫০ জন মহিলা ওই যন্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলেন। মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প দপ্তর এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অন জুট অ্যান্ড অ্যালায়েড ফাইবার টেকনোলজি ওই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটির অধিকর্তা এ এন রায় বলেন, 'মালয়েশিয়ায় এই কাজে সাফল্য এসেছে। ভারতেও সম্ভব। কেননা, আনারসের পাতা থেকে ভালো মানের সুতো পাওয়া যায়।'

শিলিগুড়ি জেলা শিল্প কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার গৌতম চৌধুরী বলেছেন, 'এই মহিলারা আনারস থেকে সুতো বের করার পেশাই পছন্দ করেছেন। হয়তো কাঁচামাল সহজলভ্য বলেই এমনটা হয়েছে। আমরাও সাহায্য করব ঠিক করেছি।' এতে আনারস থেকে বিকল্প আয়ের ব্যাপারে আশাবাদী চাষিরা। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম আনারস উৎপাদন কেন্দ্র বিধাননগর। কিন্তু চাষিরা আনারস আবাদ করে নিয়মিত সেভাবে লাভের মুখ দেখেন না। বিকল্প আয়ের সন্ধান পেয়ে উৎফুল্ল বিধাননগরের আনারস চাষিদের পরিবারের মহিলাদের নিয়ে তৈরি সমবায় সংস্থার সদস্যরা। সমবায়টি সম্পাদক পম্পা পাল মণ্ডল বলেছেন, 'আনারসের দামের কোন ঠিক নেই। প্রায় প্রতি বছরই ভালো দাম মেলে না। অথচ এই এলাকায় হাজার হাজার চাষির এটাই রুজি। বাধ্য হয়েই বিকল্প আয়ের কথা ভাবতে হয়েছে। সুতো তৈরির কাজে সফল হলে আমাদের আনারস চাষিদের পরিবারগুলি বেঁচে যাবে।' 

কোচবিহারের বামনহাট থেকে মালদহের নালাগোলা পর্যন্ত এলাকা নিয়েই রাজ্যে আনারস চাষের মানচিত্র। তার মধ্যে শিলিগুড়ির বিধাননগর এবং উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় আনারস চাষই অন্যতম রুজি। এখানকার আনারসের প্রায় ৮০ শতাংশ যায় দিল্লির বাজারে। বাকিটা রাজ্যে বিক্রি হয়। একটা আনারস বিক্রি করে চাষি পান বড়জোর ৬-৭ টাকা। খোলাবাজারে কিন্তু ৩০ টাকার কমে একটা আনারস কেনা কঠিন। তার উপর বিধাননগরে আনারস উন্নয়ন কেন্দ্র তৈরি হলেও তা আজও চালু হয়নি। আনারস সংরক্ষণে হিমঘরও নেই। চাষিদের আনারস চাষের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই। মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। এমনকি, আনারসের সঙ্গে যে লঙ্কা, সরষে কিংবা বেগুনের মতো সব্জি চাষ করা যায়, সে সম্পর্কে ধারণা নেই কৃষকদের। বিধাননগর আনারস উৎপাদক সমিতির সম্পাদক অরুণ মণ্ডল বলেছেন, 'দেখি মহিলাদের সমবায় সুতো তৈরি করে আমাদের পাশে দাঁড়াতে পারে কি না।'