১০০ মহিলা চাষিকে নিয়ে শুরু, ‘শেতকরী’র গল্প নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে গোদাবরী


তাঁরা খেতে কাজ করেন। অথচ তাঁদের কেউ 'শেতকরী' বলেন না। মরাঠি ভাষায় যার অর্থ চাষি। সেই পরিচয় অর্জনেই লড়াই শুরু মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদ জেলার মহিলা চাষিদের। আর যাঁকে কেন্দ্র করে এই জোট বাঁধা, তিনি নিজেই সেই লড়াইয়ের কথা পৌঁছে দিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে।

ওসমানাবাদের তুলজাপুরের বাসিন্দা গোদাবরী ডাঙ্গে। ব্যক্তিজীবনের ঘটনাপ্রবাহেই গোদাবরীর অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই শুরু। বাড়িতে চার বোনের মধ্যে তিনিই বড়়। গ্রাম থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে হাইস্কুল। সপ্তম শ্রেণিতে স্কুলের পাঠ শেষ। তার পরে বিয়ে। তুলজাপুর থেকে ফোনে মাঝবয়সি গোদাবরী বলেন, ''স্বামী গাড়ির চালক। দুই ছেলেও হল। ভাবলাম, সংসার করব।'' কিন্তু তা হল না। বিয়ের চার বছরের মাথায় দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যু হল। পাশে থাকলেন বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি। কিন্তু গোদাবরী? তিনি ডুকরে কাঁদেন চৌহদ্দির মধ্যে।

তবে এক বছর বাদে উঠে দাঁড়ালেন। গ্রামের স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে মিলল সাফল্য। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গোদাবরীকে সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ করল। সেই সঙ্গে ২০০০ সালে দশম শ্রেণির পরীক্ষায় পাশ করলেন। কাজের সূত্রেই গোদাবরী দেখছিলেন চারপাশের মহিলা চাষিদের। গোদাবরীর কথায়, ''কৃষি বিজ্ঞানকেন্দ্র বা কৃষি দফতরের কর্তা, কেউই তখন মহিলাদের 'শেতকরী' বলতেন না। শুধুই বলতেন, অমুক চাষির স্ত্রী, বোন ইত্যাদি।'' স্থানীয় মহিলা চাষি অর্চনা ভোঁসলে, রজনী যাদব, মহানন্দা ভোঁসলেরাও জানান, খেতে-খামারে মহিলাদের সংখ্যা যথেষ্ট। কিন্তু কী চাষ হবে, কী সার দেওয়া হবে, এ সব 'নীতি নির্ধারণে' তাঁদের ভূমিকা ছিল না।

ছবিটা বদলাতে শুরু করল ২০১২-য়। সে বছর রাজ্যে ভয়ঙ্কর খরা। চাষির ঘরে ফসল নেই। এই সময়েই গোদাবরী তৈরি করলেন, 'শেতকরী সখী গ্রুপ'। অন্তত ১১০টি গ্রামে ঘুরে বাড়ির লোক জনকে বুঝিয়ে একশো জন মহিলা চাষিকে নিয়ে শুরু হল পথ চলা। শুরু হল জৈব চাষের প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়াও। তার পরেই বাড়ি থেকে সরকারি অফিস, মহিলা চাষিদের উপরে ভরসার জায়গাটা তৈরি হতে থাকল। 

অর্চনার বলেন, ''এক বার বছর শেষে স্বামী, শাশুড়ি অবাক। কারণ বাড়তি সঞ্চয় হয়েছে। বললাম, জমির আনাজেই সংসার চলেছে। তাই এমনটা। এটা সম্ভব হয় গোদাবরী তাইয়ের জন্যই।'' এই মুহূর্তে ওসমানাবাদ জেলায় গোদাবরীদের ওই গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত হাজার। জেলার কৃষি দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর সুভাষ চোলেও বললেন, ''মহিলা চাষিদের পাশে দাঁড়াতে যাবতীয় সরকারি সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করি আমরা।''

চারপাশও বদলেছে খানিকটা। জেলা গ্রামীণ উন্নয়ন দফতর গোদাবরীকে দিয়েছে সেরা প্রশিক্ষকের পুরস্কার। তবে ''মহিলারাও যে 'চাষি', এটা বোঝাতে পারাটাই সেরা পুরস্কার'', বলছিলেন গোদাবরী। সেই 'পুরস্কার' প্রাপ্তির পথটা কেমন, সে কথা বলতেই গোদাবরী ২০১১-য় গিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায়। গিয়েছেন, ইটালি, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া-সহ প্রায় ১৪টি দেশে। ব্যক্তিজীবনেও আঁধার কেটেছে। গোদাবরীর দুই ছেলের এক জন কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছেন। অন্য জন, বিজ্ঞানে স্নাতক করে ব্যবসা শুরু করেছেন।

আর গোদাবরীর লক্ষ্য, ''মেয়েদের চাষের মতো গুরুদায়িত্ব ছাড়া হচ্ছে। এই ভরসা আর অধিকার আদায়ের লড়াইটা চালিয়ে যেতে চাই।''