৩৪ বছর আগে দেহরক্ষীর গুলিতে খুন হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী


১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এই ঘটনা ভারতের ইতিহাসে ইন্দিরা হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। সেদিন প্রিয়দর্শিনীকে তাঁরই দুই শিখ দেহরক্ষী সৎবন্ত সিংহ ও বিয়ন্ত সিংহ অপারেশন ব্লু স্টার চলাকালীন "স্বর্ণমন্দির" শিখদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের প্রতিশোধ নিতেই হত্যা করেছিল। আর তারপরে শিখ বিরোধী দাঙ্গা হয়েছিল দেশজুড়ে৷

পূর্ব কর্মসূচি অনুসারে সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভকে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য যাওয়ার পথে সকাল ৯টা ২০ মিনিটের গুলিবিদ্ধ হন। এই ব্রিটিশ অভিনেতা আইরিশ টেলিভিশনের জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছিলেন। ১ নম্বর আকবর রোডের অফিসের কাছেই অবস্থিত ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাসভবনের বাগানের একটি পথ দিয়ে তখন হাঁটছিলেন ইন্দিরা।

তিনি যখন সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিংহের প্রহরাধীনে উইকেট গেট দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখন এরা তার ওপর গুলি চালায়। সাব-ইনস্পেক্টর বেয়ান্ত সিং তার সাইড আর্ম থেকে তিনটি গুলি ছোড়েন তার তলপেটে। এরপর তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সতওয়ান্ত সিং তার স্টেনগান থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলি করার পর উভয়ই তাদের অস্ত্র হাত থেকে ছুড়ে ফেলেন। তখন বেয়ন্ত সিং বলেন, 'যা করার ছিল, আমি তা করে ফেলেছি, তুমি যা করতে চাও করো'। পরবর্তী ৬ মিনিটের মধ্যে ইন্ডো-তিব্বতান বর্ডার পুলিশের রমেশ সিং জামওয়াল ও রাম শরণ বেয়ান্ত সিংকে ধরে একটি আলাদা কক্ষে নিয়ে হত্যা করে। কারণ অভিযোগ ওই সময় বেয়ান্ত সিং এ কক্ষের এক কর্তার কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।

অপর দিকে গান্ধীর অন্যান্য দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিংকে ধরে ফেলে এবং গ্রেফতার করে। তার সঙ্গে পালাতে গিয়ে কেহার সিং নামক আরও একজন গ্রেফতার হন। অভিযোগ রয়েছে, ইন্দিরা গান্ধীর সেক্রেটারি আর কে দেওয়ানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরার পাহারা থেকে শিখ সদস্যদের সরিয়ে দিতে। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষা করা হয়েছিল। কারণ বেয়ান্ত সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর খুবই প্রিয় দেহরক্ষী। তাকে তিনি চিনতেন ১০ বছর ধরে। ঘটনার সময় অন্য খুনি সতওয়ান্ত সিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস আগে তাকে ইন্দিরার প্রহরী নিয়োগ করা হয়।

দূরদর্শনের অ্যাংকর টেলিভিশন সাংবাদিক সালমা সুলতানা ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দূরদর্শনের সন্ধ্যা ছটার খবরে ইন্দিরা হত্যার খবর প্রচার করেন। অর্থাৎ সেদিন এই মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয় তাকে গুলি করার ১০ ঘণ্টা পর।যদিও গুলিচালনার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে। সেখানে তার ওপর অপারেশন চালানো হয়। বেলা ২টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

এরপর অবশ্য চলে ময়নাতদন্ত। ময়নাতদন্ত দলের নেতৃত্ব দেন ডা: টি ডি ডোগরা। তিনি জানিয়েছিলেন, কমপক্ষে ৩০টি বুলেট বিদ্ধ হয় ইন্দিরার শরীরে। বুলেট ছোড়া হয় স্টেনগান ও পিস্তল থেকে। খুনিরা ৩১টি বুলেট ছুড়লেও একটি তার গায়ে লাগেনি। গায়ে লাগা ৩০টি গুলির মধ্যে ২৩টি গুলি শরীরের এক পাশে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ৭টি গুলি দেহের ভেতরেই থেকে যায়। ডা: ডোগরা ইন্দিরার দেহ থেকে বের করে আনা বুলেটগুলোর ব্যালিস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে পারেন এগুলো কী ধরনের অস্ত্র থেকে ছোড়া হয়েছে। এই বুলেটগুলো সিএফসিএল দিল্লির সংশ্লিষ্ট অস্ত্রের সাথে মিলে যায়। পরবর্তী সময়ে ডা: ডোগরা একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাজির হন শ্রী মহেশ চন্দ্রের আদালতে। আদালত কয়েকটি অধিবেশনে তার সাক্ষ্য নেয়। তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের উকিল শ্রী পি এন লেখি।

৩ নভেম্বর মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থল রাজঘাটের নিকটস্থ শক্তিস্থল নামক স্থানে তাঁর সৎকারক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী চার দিনে ব্যাপক হিংসাত্মক ঘটনায় প্রাণ হারান বেশ কয়েক হাজার শিখ। এই ঘটনা ঘটে মূলত ঘটেছিল দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। ইন্দিরা-হত্যার তদন্তের জন্য গঠিত জাস্টিস ঠক্কর কমিশন ষড়যন্ত্রের জন্য পৃথক তদন্তের পরামর্শ দেয়। তবে সৎবন্ত সিংহ ও ষড়যন্ত্রকারী কেহার সিংহ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি তাঁদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।