কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা; কী বলছে আইন?


শৈশবে নিজের কাকার কাছে নিয়মিত যৌন নির্যাতনের শিকার হত মীরা। চকোলেট দেওয়ার নাম করে বাথরুমে নিয়ে যেত কাকা। ইমতিয়াজ আলির 'হাইওয়ে' দেখতে গিয়ে বাস্তবের মীরারা সে দিন রাগে ফুঁসছিলেন সিনেমাহলে বসেই। ঠিক সময় প্রতিবাদ করতে না পারার রাগ। যৌন হেনস্থার প্রতিবাদে ঠিক সময়ে রুখে দাঁড়াতে না পারাটাও নতুন কিছু নয়। বরং হেনস্থার শিকার হয়ে কুঁকড়ে যাওয়াই বেশি পরিচিত ঘটনা। বলতে না পারা যন্ত্রণাগুলো বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভর। সেই সব যন্ত্রণাকে অস্ত্র করে হঠাৎ প্রতিবাদে শামিল মেয়েরা। এ প্রতিবাদ মানছে না দেশ, কাল, সীমানার গণ্ডি। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় পাতায় চলছে হ্যাশট্যাগ 'মি টু' (#MeToo) প্রচার। হলিউডের অ্যাঞ্জেলিনা জোলি থেকে মফস্‌সলের আটপৌরে গৃহবধূ, বাদ পড়ছেন না কেউ। স্বামী, প্রেমিক, বন্ধু, পরিবারের সদস্য, অফিসের বস, সহকর্মী কিংবা সম্পূর্ণ অচেনা কারও দ্বারা জীবনের কোনো না কোনো সময় শারীরিক অথবা মানসিক ভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন, এমন মেয়েরা সব এসে জড়ো হচ্ছেন এক ছাতার তলায়, যার নাম #MeToo।

বিগত কয়েক দিনে ভারতে আবার নতুন করে শিরোনামে এসছে #MeToo প্রতিবাদ। জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের (তাদের কেউ পেশায় অভিনেতা, কেউ প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক) দ্বারা যৌন হেনস্থার শিকার হয়ে পরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন দেশের মহিলারা। সে সব প্রতিবাদ নিয়ে জল্পনা বা বিতর্ক কম হচ্ছে না। কিন্তু এর মাঝে বারবার উঠে এসেছে একটা প্রশ্ন।  কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞাটা ঠিক কী?

এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা দরকার কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা সংক্রান্ত  'সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অব ওয়মেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস অ্যাক্ট'  আইন পাশ হয় ২০১৩ সালে। এই আইনের ভিত্তিতে মহিলারা যৌন হেনস্থার অভিযোগ করতে পারেন। ২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত মহিলাদের যৌন হেনস্থার প্রতিবাদের জন্য বিশাখা নির্দেশিকা ছিল। নতুন আইন সেই বিশাখা নির্দেশিকাকে আরও শক্তিশালী করে।

বিশাখা নির্দেশিকা
১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই নির্দেশিকা জারি করে। ১৯৯২ সালে রাজস্থানে এক বছরের এক শিশুর বিয়ে দেওয়া থেকে তার পরিবারকে প্রতিহত করায় সে রাজ্যের এক সমাজকর্মী ভবানী দেবীকে গণ ধর্ষণ করা হয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদে জনস্বার্থ মামলা করে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা এক সংস্থা। সংস্থার নাম থেকেই শীর্ষ আদালতের জারি করা নির্দেশিকার নাম হয় বিশাখা।

নির্দেশিকায় তিনটি বিষয়ের ওপর স্পষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। নিষেধ (প্রহিবিশন), প্রতিরোধ (প্রিভেনশন) এবং প্রতিকার (রিড্রেস)। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিকায় জানিয়েছে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা হলে অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। ২০১৩-এর আইন অনুযায়ী ১০ কিমবা তার বেশি সংখ্যক কর্মী রয়েছে এমন সংস্থার নিয়োগকর্তার ইন্টার্নাল কমপ্লেইন্টস কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূূলক। এই আইনের আওতায় পড়বে কর্মক্ষেত্রে উপ্সথিত প্রতিটি মানুষ। শুধু মহিলা কর্মীই নয়, বিশেষ কোনো কাজে সংস্থায় এসেছেন এমন মহিলা থাকলে তিনিও এই আইন দ্বারা সুরক্ষিত।

যৌন হেনস্থার সংজ্ঞা ঠিক কী?

নীচে উল্লেখ করা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি হলেই কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা হিসেবে গ্রাহ্য হবে তা

১) শারীরিক ছোঁয়া এবং তার থেকে বেশি কিছু

২)যৌন প্রশ্রয়ের দাবি

৩)যৌন মন্তব্য

৪)পর্নোগ্রাফি দেখতে বাধ্য করা

৫)যে কোনো মৌৌখিক, শারীীরিক, আচরণগত যৌন হেনস্থা

৬)মহিলার যৌন জীবন নিয়ে বারবার অসংলগ্ন প্রশ্ন করা, মন্তব্য করা, আপত্তিজনক যৌনতাপূর্ণ এমএমএস, এসএমএস, ই-মেইল,
হোয়াটস-আপ, ছবি কিমবা পোস্টার দেখানো

৭)যৌন পক্ষপাত দাবি করে কোনো মন্তব্য করা, হুমকি দেওয়া, প্রতিবাদ করলে তার উদ্দেশে যৌন মন্তব্য করা

৮)যৌনতার মোড়কে সামাজিক আমন্ত্রণ, যা ফ্লার্টিং হিসেবে বেশি পরিচিত

যিনি হেনস্থার শিকার, তাকেই কি অভিযোগ করতে হবে?

যৌন হেনস্থার শিকার যিনি হচ্ছেন, তাঁর নিজের মানসিক অবস্থা অনেক সময় এমন থাকে না, যেখান থেকে সেই মহিলা অভিযোগ করতে পারবেন। তাঁকেই যে অভিযোগ করতে হবে, সে ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাঁর হয়ে অন্য যে কেউ লিখিত অভিযোগ জানাতে পারে। মৃত্যু বা শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে মহিলার বৈধ উত্তরূরিও অভিযোগ আনতে পারেন।

অভিযোগ করার নির্দিষ্ট সময় সীমা রয়েছে?

আইন মাফিক যৌন হেনস্থা ঘটার তিন মাসের মধ্যে লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে। বারবার এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে শেষ ঘটনা ঘটার তিন মাসের মধ্যে অভিযোগ আনতে হবে। যদিও সময় সীমার ক্ষেত্রে আইন খুব একটা কড়া নয়। মহিলার ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে, তিন মাসের মধ্যে তিনি অভিযোগ জানাতে পারলেন না, সেরকম পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই এ ব্যাপারে কড়া নিয়ম নেই।

যৌন হেনস্থার অভিযোগ করলে কত তাড়াতাড়ি তদন্ত শুরু হয়?

আইনের ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী আদালত কোনো পদক্ষেপ করার আগে দু'পক্ষের মধ্যে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া কাম্য। যদিও সেক্ষেত্রে দু'পক্ষের মধ্যে আর্থিক আদানপ্রদান নিষিদ্ধ।

তদন্তের পদ্ধতি কী?

ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় অভিযোগ না পাঠানো পর্যন্ত অভিযোগ কমিটি তদন্ত শুরু করতে পারে না। অভিযোগ দায়ের করার ৯০ দিনের মধ্যে পদক্ষেপ নিতেই হবে অভিযোগ কমিটিকে। তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার ১০ দিনের মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে হয় অভিযোগ করা কর্মীর কাছে। কর্মীর পরিচয় গোপন রাখা হয় সেক্ষেত্রে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিয়োগকারী সংস্থাকে বলা হয় অভিযুক্তকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য। যৌন হেনস্থার শাস্তির পরিমাণ অবশ্য সংস্থার ওপর নির্ভর করে।

অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ হলে কী হয়?

আইনের ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণিত হলে অভিযোগ কমিটি সংস্থাকে নির্দেশ দেয়, অভিযোগকারিনীর বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়া হোক। তবে আইনে স্পষ্ট বলা আছে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে যৌন হেনস্থার সত্যতা প্রমাণ না করা গেলে মহিলার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ করা যাবে না।