ডিএনএ পরীক্ষায় কী কী জানা সম্ভব?


ডিএনএ কথা বলে! হ্যাঁ, হাজারও ফাইল, নথি-তথ্য ঘেঁটেও যা জানা যায় না, অনেকসময়ই সেই অন্ধকারে আলো ফেলতে পারে মানুষের কোষের ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ। কী কী জানা যেতে পারে ডিএনএ পরীক্ষা থেকে জানালেন প্রবীণ ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ অজয়কুমার গুপ্ত ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক ও স্টেট মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ বিশ্বজিৎ সুকুল।


পরিচয়
একটি বাচ্চা। ধরা যাক তাঁর নাম মধু। মানুষটি তাঁর মা, বাবা, ভাই-এর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছিল। তারপর হঠাৎ মধু নিখোঁজ।
বছর ২০ পরে অকস্মাৎ এক ব্যক্তি এসে দাবি করলেন— বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া মধুই হলেন তিনি!
দু'দশক সময়টা কম নয়। অনেককিছুই বদলে যায়। বদলে যায় মানুষের মুখ! তাহলে উপায়? 
অব্যর্থ উপায় হল ডিএনএ টেস্ট। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ও নিজেকে মধু বলে দাবি করা ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত নিতে হয়। এরপর সেই নমুনগুলির ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বাবা ও মায়ের সঙ্গে ওই মানুষটির ডিএনএ মিলে গেলেই বুঝতে হবে ওই ব্যক্তিই আসল 'মধু'।

শারীরিক নির্যাতনমূলক অপরাধ
পরিচয় জানা ছাড়াও অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করতেও ভরসা এই পরীক্ষা। ধরা যাক কোনও মহিলা শারীরিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন একজন বা কয়েকজনের বিরুদ্ধে। অথচ অভিযুক্তরা অভিযোগ অস্বীকার করছেন। এই সমস্ত ক্ষেত্রেও ডিএনএ টেস্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। কারণ মানুষের দেহের যে কোনও ধরনের ফ্লুইড, অর্থাৎ লালা, সিমেন, মায়ের দুধ, এছাড়া ইউরিন সহ অন্যান্য ফ্লুইডেও কোষ থাকে। আর কোষ থাকলে ডিএনএ পাওয়া যায়। ফলে অভিযোগের ভিত্তিতে, নির্যাতিতার দেহ থেকে অপরাধীর ছেড়ে যাওয়া ফ্লুইড সংগ্রহ করে তাঁর 'ডিএনএ' এবং অভিযুক্তদের ডিএনএ সংগ্রহ করে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে প্রকৃত অপরাধী কে!

পিতৃপরিচয়
নানা ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, কোনও মহিলার গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃপরিচয় জানার জন্যও ডিএনএ টেস্ট কার্যকরী।
এক্ষেত্রে সন্তান জন্মানোর পর মহিলার ডিএনএ, বাচ্চার ডিএনএ ও সন্দেহভাজন পুরুষের ডিএনএ-এর পরীক্ষা করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে সন্দেহভাজনই আসল পিতা কি না।

একটি চমকপ্রদ ঘটনা
অসমের একটা ঘটনার কথা বলা যায় এই প্রসঙ্গে—
এক বাড়িতে চার ভাই থাকতেন। একজন বয়স্ক বিপত্নীক। দ্বিতীয় ভাই-এর নাম পুলিসের খাতায় আছে। বাকি দু'জন সাধারণ। ওই বাড়ির পরিচারিকা হঠাৎ করে আত্মহত্যা করে। পুলিস কেস শুরু হয়। পোস্টমর্টেম করে দেখা যায়, পরিচারিকা ছ'মাসের সন্তানসম্ভবা ছিলেন। এবার শুরু হয় তদন্ত। কে ওই সন্তানের পিতা? স্বাভাবিকভাবেই পুলিসের খাতায় যে ভাই-এর নাম ছিল, তাঁর, মহিলার এবং বাচ্চার রক্তের নমুনা নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয়। পরীক্ষায় ডিএনএ ম্যাচ করে না! ওই কেসের তদন্তকারী অফিসার হাল না ছেড়ে ফের আদালতে আবেদন জানায়— ওই বাড়ির বাকি তিনজনেরও ডিএনএ টেস্ট করানো হোক। আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পরে দেখা গেল— বয়স্ক বিপত্নীক ব্যক্তিই সন্তানের পিতা!

মৃত ব্যক্তির পরিচয়
অনেকক্ষেত্রে খুন করার পর, দুষ্কৃতীরা মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে দেয়। পরবর্তীকালে ওই মৃতদেহের সঠিক পরিচয় জানার জন্য ডিএনএ পরীক্ষাই একমাত্র প্রমাণ হতে পারে।
মুশকিল হল, দীর্ঘদিন ধরে মাটির নীচে থাকার জন্য মৃতদেহের শরীরের বেশিরভাগ অংশ পচে, গলে যায়। অথচ মৃতদেহ থেকে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করতেই হবে। এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট নমুনা হল, হাড়ের মধ্যে থাকা মজ্জা। সবথেকে ভালো হয়, একটি গোটা অস্থি পাওয়া গেলে। কারণ অস্থির মধ্যে থাকে প্রচুর কোষ। সেখান থেকেই ডিএনএ সংগ্রহ করা যেতে পারে।

বংশপরিচয়
কোনও ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা থেকে পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহ এবং তার পরবর্তী কয়েক ধাপ পর্যন্ত বংশ পরিচয় জানা সম্ভব!

ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ
ডিএনএ টেস্টের ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ফরেনসিক সায়েন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে স্যাম্পেল কালেকশনের মূলত তিনটি ভাগ রয়েছে। জীবিত মানুষের দেহ থেকে, মৃত মানুষের দেহ থেকে এবং কোনও ঘটনাস্থল থেকে।
এক্ষেত্রে যে কোনও অক্ষত কোষকে নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা যেতে পারে। জীবিত ও মৃত মানুষের রক্ত, পেশি, থুতু, মূত্র, চামড়া, হাড়, দাঁত ইত্যাদি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব। মৃত মানুষের ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহ করতে হয় ময়নাতদন্তের সময়।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহের নমুনা সংগ্রহ করা হয় কীভাবে? উত্তর হল, সাধারণত দেহ যতই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ুক না কেন, দাঁত অক্ষতই থাকে। দাঁত প্রাকৃতিকভাবে শক্ত। বাইরে থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে কম। তাই মৃতদেহের অবস্থা খুব খারাপ হলে নমুনা হিসেবে দাঁত নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মূলত উপর বা নীচের চোয়ালের পিছনের তিনটি দাঁতের মধ্যে থেকে স্যাম্পেল রাখতে পারলে ভালো। তবে যে কোনও দাঁতই নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। 
এছাড়া শরীর ক্ষতবিক্ষত হলেও হাত, পা সহ শরীরের লম্বা হাড়গুলিও সাধারণত ঠিক থাকে। তাই এক্ষেত্রে অনায়াসে এই হাড়ের অস্থিমজ্জা নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা যায়।
ডিএনএ টেস্ট কি সবাই করাতে পারেন?

ডিএনএ টেস্ট অত্যন্ত আধুনিক এক পরীক্ষা পদ্ধতি। দেশের হাতে গোনা ল্যাবেই এই টেস্ট হয়। মূলত সরকারিভাবে পুলিস বা গোয়েন্দা সংস্থা আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এই টেস্টগুলি করার কথা বলে। সেইমতো ফরেনসিক সায়েন্স বিশেষজ্ঞরা নমুনা সংগ্রহ করেন। সেই নমুনা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে পুলিস বা সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর সেই নমুনা সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে দিয়ে আসতে হয়। সেখানেই মেলে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল।

ডিএনএ এবং আঙুলের ছাপ
যে কোনও ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্ট এবং আঙুলের ছাপের একটা বড় ভূমিকা রয়ে গিয়েছে। কিন্তু আইডেন্টিক্যাল ট্যুইন বা অভিন্ন যমজের ডিএনএ প্রোফাইলিং একই হয়। তাই এঁদের মধ্যে কোনও একজনকে সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের তুলনায় আঙুলের ছাপকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের আঙুলের ছাপ ভিন্ন। এমনকী আইডেন্টিকাল ট্যুইন বা অভিন্ন যমজের ক্ষেত্রেও আঙুলের ছাপ আলাদাই হয় (তবে যমজের ক্ষেত্রে ৬৪ হাজার মিলিয়ন যমজের মধ্যে মাত্র একটি ক্ষেত্রেই আঙুলের ছাপ একরকম হতে পারে!)।

ডিএনএ টেস্টের সীমাবদ্ধতা রয়েছে—
 ডিএনএ টেস্টের নমুনা সংগ্রহের কাজটি বিশেষ সচেতনতার সঙ্গে করতে হয়। সামান্য ভুলত্রুটি থেকেও নমুনা অশুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। এর থেকে টেস্টের ফলাফল ভুল হয়  ডিএনএ টেস্ট বেশ সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি  এই টেস্টের খরচও তুলনামূলকভাবে বেশি  বিভিন্ন নিয়ম মেনেই ডিএনএ টেস্ট করতে হয়। বিশেষত জীবিত মানুষের নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেশকিছু পদ্ধতি রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য কোর্টের অর্ডার ও পুলিসের রিক্যুইজিশন ফর্ম লাগে। এরপর নির্দিষ্ট দিনে ব্যক্তি ল্যাবে উপস্থিত হন। ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাঁর সম্মতি এবং বাচ্চা হলে তাঁর অভিভাবকের সম্মতিমতো নমুনা সংগ্রহের কাজটি হয়।