চিনে সমলিঙ্গের মাধ্যমে বাচ্চার জম্ম দেওয়া সম্ভব হল


বেজিং: পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে এক অদ্ভূত কাজটা করে দেখিয়েছেন চিনের বিজ্ঞানীরা ৷ দুটি সমলিঙ্গের মাধ্যমে বাচ্চার জম্ম দেওয়া সম্ভব ৷ বিজ্ঞানীরা দুটি সমলিঙ্গের ইঁদুরের উপর এই বিরল পরীক্ষা চালায়৷ তারফলে দুটি মা ইঁদুর থেকে জন্ম দেওয়া গিয়েছে বাচ্চা ইঁদুরের ৷ সেক্ষেত্রে কোনও বাবা ইঁদুরের দরকার পড়েনি।

চিনের একাডেমি অব সায়েন্সে প্রাণী জগতে প্রজননের নিয়ম পাল্টে দেওয়া এমন অভিনব গবেষণাটি করা হয়েছে । সেখানকার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, দুটি মা ইঁদুর থেকে জন্ম নেওয়া এই বাচ্চা ইঁদুরগুলি সুস্থ ও স্বাভাবিক। তারাও পরে বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দিয়েছে। তবে একই পরীক্ষা যখন পুরুষ ইঁদুরদের উপরও চালানো হয় তখন তারা জন্ম দিয়েছে বাচ্চা ইঁদুরের তবে সেই সব বাচ্চা ইদুরগুলি বেশিদিন বাঁচেনি। কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যায়।

এক্ষেত্রে গবেষকরা আসলে একটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেয়েছেন – প্রজননের জন্য দুই বিপরীত লিঙ্গ আসলে কতটা অপরিহার্য। সাধারণত এটাই জানা আছে মানুষ থেকে শুরু করে সব ধরণের স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে কেবলমাত্র দুই বিপরীত লিঙ্গের মিলনের মাধ্যমেই নতুন বাচ্চা জন্ম দেওয়া সম্ভব। কারণ সন্তানের জন্মের জন্য মায়ের কাছ থেকে দরকার হবে ডিম্বাণু, বাবার কাছ থেকে শুক্রাণু প্রয়োজন হয়।

এবার চিনের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে প্রশ্ন তুলে দিলেন, প্রজননের ক্ষেত্রে পুরুষের অপরিহার্য ভূমিকা তবে কি ফুরিয়ে গেল? অর্থাৎ কুমারীর পক্ষেও এখন সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব, যাকে বলা হয় 'পার্থেনোজেনেসিস।' প্রজননের ক্ষেত্রে যে নিয়ম-কানুন, তার কোনটি ভাঙ্গতে পারলে একই লিঙ্গের দুজনকে ব্যবহার করে নতুন প্রাণীর জন্ম দেওয়া সম্ভব- সেটাই চিনা গবেষকরা জানার চেষ্টা করছিলেন।

দুই মা ইঁদুর থেকে বাচ্চা ইঁদুর জন্ম দেওয়ার কাজটা তুলনায় সহজ ছিল। তারা একটি মেয়ে ইঁদুর থেকে একটি ডিম্বাণু নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় মেয়ে ইঁদুর থেকে নিয়েছেন এক ধরণের বিশেষ সেল বা কোষ। এগুলোকে বলা হয় 'হ্যাপলয়েড এমব্রোয়োনিক স্টেম সেল।' নতুন প্রাণের জন্ম দেয়ার জন্য যত জেনেটিক কোড বা ডিএনএ দরকার, এই দুটিতে ছিল তার অর্ধেক অর্ধেক। কিন্তু দুটিকে মেলানোই যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞানীরা 'জিন এডিটিং' এর মাধ্যমে এই দুটি থেকে তিন জোড়া করে জেনেটিক কোড ডিলিট করেছেন বা মুছে ফেলেছেন যাতে করে তাদের মধ্যে মিলন সম্ভব হয়।

আবার দুই বাবা ইঁদুরের ক্ষেত্রে কৌশলটা ছিল কিছুটা আলাদা। বিজ্ঞানীরা একটি পুরুষ ইঁদুর থেকে নিয়েছেন একটি শুক্রাণু, অন্য পুরুষ ইঁদুর থেকে নিয়েছেন একটি হ্যাপলয়েড এমব্রোয়োনিক স্টেম সেল। এটি আসলে এক ধরণের ডিম্বাণু, যা থেকে 'জিন এডিটিং' এর মাধ্যমে অনেক তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে।

এই যে প্রকৃতির নিয়ম ভেঙ্গে চিনা বিজ্ঞানীরা একই লিঙ্গের ইঁদুর ব্যবহার করে বাচ্চা জন্ম দিতে সফল হয়েছেন, ফলে বুঝেছেন প্রজননের ক্ষেত্রে দুই বিপরীত লিঙ্গ কেন অপরিহার্য। এক্ষেত্রে দু ধরণের বিপরীত লিঙ্গের দরকার পড়ে, কারণ আমাদের ডিএনএ বা জেনেটিক কোড বাবা নাকি মা, কার কাছ থেকে আসছে, তার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। জেনেটিক কোডের একটি যদি পুরুষ এবং একটি নারী থেকে না আসে তাহলে পুরো শারীরিক-মানসিক বিকাশ গোলমেলে হয়ে পড়ে।

অর্থাৎ যে ডিএনএ শুক্রাণু থেকে এবং যে ডিএনএ ডিম্বাণু থেকে আসে, তাতে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের 'ছাপ' থাকে। এটিকে বলে 'জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং'। সেটাই আসলে নির্ধারণ করে কিভাবে এই দুয়ের সংযোগে নতুন কি তৈরি হবে।এই জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং এর ক্ষেত্রে যদি কোন ভুল হয়, তখন নানা রকম রোগ হতে পারে, যেমন 'অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম।' চিনা বিজ্ঞানীরা যখন একই লিঙ্গের ইঁদুর ব্যবহার করে নতুন বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দিয়েছেন, তখন তাদের জেনেটিক এডিটিং এর মাধ্যমে এই জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং বা ছাপ সংশোধন করতে হয়েছে বা মুছে ফেলতে হয়েছে। যাতে করে নতুন ইঁদুর জন্ম দেয়া সম্ভব হয়, সেটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়।
 
এই পরীক্ষা যারা চালিয়েছেন, তাদের একজন ড: ওয়েই লি বলেন, "আমরা এই গবেষণার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি কী করা সম্ভব। আমরা দেখেছি দুই মা থেকে যে বাচ্চা ইঁদুর হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে অনেক ত্রুটি সারিয়ে তোলা সম্ভব। স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে দুই বিপরীত লিঙ্গের অপরিহার্যতাকে অতিক্রম করা সম্ভব।"

তার মানে কী একই লিঙ্গের মানুষ থেকে মানবশিশুর জন্ম সম্ভব? ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডের ড: টেরেসা হোম বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে এর সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁর মতে, এই গবেষণার মাধ্যমে একই লিঙ্গের যুগলরা নিজেরাই যেন স্বাস্থ্যবান শিশুর জন্ম দিতে পারেন, তার পথ খুলে যেতে পারে। পাশাপাশি তিনি অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে এই পথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক প্রশ্নের মীমাংসার দরকার হবে। অনেক ধরণের ঝুঁকি মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করার দরকার হবে।তার মতে যতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত না হবেন যে এভাবে জন্ম নেওয়া শিশু শারীরিক এবং মানসিকভাবে আর দশটা শিশুর মতই বেড়ে উঠতে পারবে, ততদিন এটা ঘটবে না।

এই পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে সকলেই আশার আলো দেখছেন এমন নয়৷ চিনা বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়ায় যেসব ইঁদুরের জন্ম দিয়েছেন, সেগুলো কতটা স্বাভাবিক তা নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে। যেমনফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের ড: রবিন লোভেল-ব্যাজের বক্তব্য, দুটি মা ইঁদুর ব্যবহার করে যেখানে বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দেওয়া হয়েছেও সেখানেও আমি নি:সন্দেহ নই যে সেগুলি স্বাভাবিক। সেখানে সাফল্যের হার কিন্তু অনেক নীচে। সেক্ষেত্রে তাঁর প্রশ্ন -এরকম কিছু করার কথা কেউ ভাববে? অর্থাৎ প্রজননের ক্ষেত্রে লিঙ্গ এখনো অপরিহার্য। এটির প্রয়োজন খুব শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে, এমনটা তিনি মানছেন না৷